যাই হোক, ইউরোপের ক্রমশ ধর্মহীনতার দিকে গমনের হার অসীম সময় পর্যন্ত চলবে না। ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের রাজনীতি ও সমাজনীতির গবেষক এরিক কফম্যান ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর জন্মহার পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন ধর্মহীনতার দিকে এই দেশগুলোর গমন চলবে মোটামুটি ২০৫০ পর্যন্ত, তারপর এটা আবার ঘুরে দাঁড়াবে এবং ২১০০ সালের মধ্যে আবার বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসবে[৩৪৪]। তবে। একটা বিষয় নিশ্চিত যে, নাস্তিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মূলত দুটি বিষয়ের ওপর : শিক্ষা এবং অর্থনীতি। যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জ্বালানী সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না হয় এবং যদি বর্তমান বিশ্বের ধনী দেশগুলো এই কারণে গরিব দেশের কাতারে নেমে আসে, যদি তাদের শিক্ষার হার নিম্নগামী হয়, তাহলে রাষ্ট্র হতে প্রথম যে জিনিসটি চলে যাবে তা হলো, নাস্তিকতা। কিন্তু আমরা যদি ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে এই সমস্যাগুলোর যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক সমাধান দিতে সক্ষম হই, যদি অধিকাংশের জন্য একটি সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা দান করতে পারি, নিশ্চয়তা দিতে পারি শিক্ষার আর তরুণ সমাজকে ক্রমশ উদ্দীপ্ত করতে পারি ইহজাগতিক বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতির প্রতি, তাহলে আর আমাদের অতিপ্রাকৃতিক কোনো স্রষ্টার দিকে মুখ করে থাকতে হবে না-যিনি আকাশ থেকে নেমে এসে সমাধান করে দিবেন, আমাদের সকল সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট এবং গ্লানির।
.
বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মুক্তমনার আত্মপ্রকাশ
বাংলাদেশে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নাম সবাই কমবেশি জানেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি। দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করার পর থেকে বাংলাদেশে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতি বছরই জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক প্রদান করে থাকে। পদক থাকে দুটি। একটি দেওয়া হয় ব্যক্তিকে, আরেকটি দেওয়া হয় সংগঠনকে। ২০০৭ সালে জাহানারা ইমামের তেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মারক সভায় ব্যক্তির জন্য বিবেচিত পদকটি পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার। আর সংগঠনের পদকটি পেয়েছিল মুক্তমনা। পদকটি মুক্তমনার পক্ষ থেকে গ্রহণ করেন অধ্যাপক অজয় রায়া পদকের স্মারক পত্রে বলা হয়েছে–
বাংলাদেশে মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তচিন্তার আন্দোলনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ‘মুক্তমনা” ওয়েবসাইট। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে ও বিদেশে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সেকুলার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করবার ক্ষেত্রে ‘মুক্তমনা ওয়েবসাইটের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের তরুণ মানবাধিকার কর্মীরা এই ওয়েবসাইটকে তাদের লেখা ও তথ্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করছেন। ২০০১ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ‘মুক্তমনা’ তখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনের পাশাপাশি আর্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য ‘মুক্তমনা ওযেবসাইটকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক ২০০৭’ প্রদান করা হলো।
বাংলাদেশে এর আগে কোনো ওয়েবসাইট জাহানারা ইমাম পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে নি। স্মারকপত্রের প্রথম লাইনটি গুরুত্বপূর্ণ। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবারের পদক প্রাপ্তির বিবেচনায় মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার পাশাপাশি মুক্তচিন্তার আন্দোলন’কেও গুরুত্ব দিয়েছে।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্নটি এসে পডে-এই মুক্তচিন্তার আন্দোলনটি কী, কেন এটি অনন্য কিংবা নিজগুণে স্বকীয়? যে সমাজ আর সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা, তার সবটুকুই যে নির্ভেজাল তা বলা যায় না। এতে যেমন প্রগতিশীল বস্তুবাদী উপাদান রয়েছে, তেমনই রয়েছে আধ্যাত্মবাদ, বুজরুকি, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আর অপবিশ্বাসের রমরমা রাজত্ব; রয়েছে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। এই অন্ধকার সুদীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরায় আমাদের চিন্তা চেতনাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে এই চেতনার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয় বরং বাস্তবিকই কঠিন ব্যাপার। রাহুল সাংকৃত্যায়ন একবার তার একটি লেখায় বলেছিলেন–
মানুষ জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠাকে বিরাট হিম্মত মনে করে। সমাজের গোঁড়ামিকে ভেঙে তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার চেয়ে ঢের বেশি সাহসের কাজ।
কথাটি মিথ্যে নয়। তাই ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায়, খুব কম মানুষই পারে আজন্ম লালিত ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে, খুব কম মানুষই পারে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। খুব কম মানুষের মধ্যে থেকেই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে একজন আরজ আলী মাতুব্বর, প্রবীর ঘোষ, হুমায়ুন আজাদ কিংবা আহমেদ শরীফ। আমাদের শাসক আর শোষকশ্রেণি আর তাদের নিয়ন্ত্রিত বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা কথনোই চায় না জনগণ প্রথা ভাঙুক, কুসংস্কারের পর্দা সরিযে বুঝতে শিখুক, জানতে শিখুক অজ্ঞতা, শোষণ আর অসাম্যের মূল উৎসগুলো কোথায়। জনগণের জ্ঞান চক্ষু খুলে গেলেই তো বিপদ, তাই না! আর সেজন্যই জনগণকে অন্ধকারে রাখতে চলে বিজ্ঞানের মোড়কে পুরে ধর্মকে পরিবেশন, লাগাতার আধ্যাত্মবাণী প্রচারণা, পত্র পত্রিকায় বড় আকারে রাশিফল, সর্পরাজ এবং আধ্যাত্মবাদী গুরু আর কামেল পীরের বিজ্ঞাপন, মন্ত্রী আর নেতা-নেত্রীদের মাজার আর দরগায় সিন্নি দেওয়া অথবা নির্বাচন উপলক্ষে হজে যাওয়া, মাথায় কালো পটি বাঁধা। মুক্তমনাদের লড়াই এই সামগ্রিক অসতোর বিরুদ্ধে, অন্ধবিশ্বাস আর অপবিশ্বাসকে উস্কে দেওয়া এই সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে। এ লড়াই বৌদ্ধিক, এ লড়াই সাংস্কৃতিক। এ লড়াই সমাজকে প্রগতিমুখী করার ব্রত নিয়ে সামগ্রিক অবক্ষয় আর অন্ধকার ভেদ করে আশার আলো প্রজ্বলিত করবার লড়াই। এ লড়াই আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে চেতনামুক্তির লড়াই।