সেকুলারিজম বহু শতাব্দী ধরে (আমাদের উপমহাদেশে) যেভাবে আচরিত এবং রূপান্তরিত হয়ে আসছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকেই যদি তার ঠিক বঙ্গানুবাদ বলে ধরে নেই, তবে শুধু সব ধর্মের সহাবস্থানেই তার অর্থ পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এ কথা সত্য যে, ধর্মনিরপেক্ষতায় তার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়; ধর্ম থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়।
ধর্ম থেকে চিন্তার মুক্তি ব্যক্তিগত পর্যায়ে না হলেও, রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে অন্তত জরুরি। ব্যাপারটি রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল।
.
ধর্মহীন সমাজ
চরমপন্থি ধার্মিকরা প্রায় বলে বেড়ান নাস্তিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজের ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিবে। বাংলাদেশের মোল্লারা ওয়াজ মাহফিলে জ্বালাময়ী কণ্ঠে ব্যাখ্যা করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা কীভাবে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। মার্কিন টেলিভাজেলিস্ট প্যাট রবার্টসন ধর্মহীন সমাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘ফলাফল হবে স্বেচ্ছাচারতন্ত্র কাযেম। আমরা বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে ধর্মহীন সমাজ নিয়ে আমেরিকার এরকম কট্টরপন্থী লেখক লেখিকাঁদের মনোভাবের উল্লেখ করেছি। যেমন-এন কোলটার তার বই ‘গডলেস’-এ বলেন, যে সমাজ ঈশ্বরের মর্যাদা বুঝতে অপারগ সেই সমাজের গন্তব্য দাসত্ব, গণহত্যা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার দিকে। তিনি আরও বলেন, যে সমাজে বিবর্তন সাধারণের কাছে সত্য বলে গণ্য সেই সমাজে নৈতিকতার স্থান কবরে। ফক্স নিউজের জনপ্রিয় উপস্থাপক বিল ও’রেইলির উদ্ধৃতিও আমরা দিয়েছি যেখানে তিনি বলেন, যে সমাজ ঈশ্বরের ছায়াতলে থাকতে ব্যর্থ সেই সমাজে আছে শুধু ‘নৈরাজ্য আর দুর্নীতি’, যেখানে ‘আইন অমান্যকারীরা ঘুরে বেড়ায় বহাল তবিয়তে[৩৪০]।
ব্রিটিশ ধর্মবেত্তা কেইথ ওয়ার্ড বলেন, যে সমাজ প্রবল ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সে সমাজ অনৈতিক, পরাধীন এবং অস্থিতিশীল[৩৪১]। দার্শনিক জন ডি. কাপুটো ঘোষণা করেন, ধর্মহীন মানুষ এবং ঈশ্বরকে ভালো না বাসা মানুষরা স্বার্থপর এবং অভদ্র, সুতরাং তাদের দিয়ে গড়া সমাজ ভালোবাসাহীন জঘন্য স্থান[৩৪২]
প্রত্যেকবারের মতো আবারও আমরা দেখতে পাই, ধার্মিকরা কেমন করে প্রমাণ অগ্রাহ্য করে, বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের বিশ্বাসের পক্ষে থাকেন। অন্ধবিশ্বাস আসলে এভাবেই কাজ করে। কোনো প্রমাণ গ্রাহ্য করে না, গ্রাহ্য করে না বাস্তবতা। আমরা সপ্তম অধ্যায়ে বহু জরিপ এবং পরিসংখ্যান হাজির করে দেখিয়েছি যে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক উপাত্ত বা ডেটা পাওয়া যায় নি যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের চাইতে বেশি অপরাধপ্রবণ; বরং কিছু পরিসংখ্যান একেবারেই উল্টো সিদ্ধান্ত হাজির করেছে। বেশকিছু দেশে চালানো বহু জরিপেই পাওয়া গেছে যে, সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মহীন হওয়া সত্বেও তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কম, বিশ্বাসীদের মধ্যেই বরং অপরাধপ্রবণতা বেশি, হত্যা, খুন রাহাজানি এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ থেকে শুরু করে শিশুনির্যাতনও। আজকে যেসব সমাজের অধিকাংশ ধর্ম থেকে মুক্ত, মুক্ত ঈশ্বর থেকে সেসব সমাজ ঘৃণ্য, জঘন্য, হানাহানিতে পরিপূর্ণ তো দূরের কথা এগুলো পৃথিবীর অন্যতম সুখী, নিরাপদ, সফল সমাজ।
আমরা বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে সমাজবিজ্ঞানী ফিল জুকারম্যানের অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেছি। তিনি ২০০৫ ০৬ সালে চোদ্দ মাস ধরে ডেনমার্ক ও সুইডেনে অবস্থান করে ধর্ম ও ঈশ্বর-সংক্রান্ত বিষয়ে অসংখ্য মানুষ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। তার ২০০৮-এর বই ‘Society without God’-এ[৩৪৩] এই সাক্ষাৎকারের ফল তিনি প্রকাশ করেন।
বেশিরভাগ ড্যানিশ এবং সুইডিশ ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘সিন’ বা পাপ নামক কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী নন অথচ দেশ দুটিতে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। এই দুই দেশের প্রায় কেউই চার্চে যায় না, পড়ে না বাইবেল। তারা কি অসুখী? ৯১টি দেশের মধ্যে করা এক জরিপ অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম, যে ডেনমার্কে নাস্তিকতার হার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা আশি ভাগ। স্ক্যান্ডিনেভিযায় মাত্র ২০ শতাংশের মতো মানুষ ঈশ্বরের বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরের জগতে। আর বাকিরা স্রেফ কুসংস্কার বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন এ চিন্তা।
ঈশ্বরহীন এইসব সমাজের অবস্থা তবে কেমন? সমাজের অবস্থা মাপার সকল পরিমাপ-গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জীবনযাপনের অবস্থা, শিশুমৃত্যুর নিম্নহার, অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা, লিঙ্গ সাম্যাবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্নীতির নিম্নহার, পরিবেশ সচেতনতা, গরিব দেশকে সাহায্য সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক ও সুইডেন অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উপরে। তবে পাঠকদের আমরা এই বলে বিভ্রান্ত করতে চাই না যে, এইসব দেশে কোনো ধরনের সমস্যাই নেই। অবশ্যই তাদেরও সমস্যা আছে। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যৌক্তিক পথ। বেঁছে নেয়, উপর থেকে কারও সাহায্যের অপেক্ষা করে না, কিংবা হাজার বছর পুরনো গ্রন্থ ঘেঁটে সময় নষ্ট করে না।