আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল, যারা নীতিগতভাবে এদেশে ধর্মনিরেপক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে সোচ্চার, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, তারাও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল সুরটি কখনোই অনুধাবন করতে পারে নি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট (http://www.albd.org/) দেখলেই। আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে মাথার উপরে আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ লেখাটি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই পরিচয় বহন করে। অথচ এক সময় আওয়ামী লীগই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি উঠিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পেরেছিল কিংবা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সেসময় রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে খুব স্বাভাবিক ছিল সে অঙ্গীকার। কিন্তু এর জন্য যে বিশাল সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন তা সে সময়কার নেতাদের যথেষ্ট পরিমাণে ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলেও এর মূল ভাবটি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে স্পষ্ট ছিল- এমন কোনো নজির পাওয়া যায় নি। পাকিস্তানি কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি বাংলাদেশকে ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন তা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। ওই বছরেরই সাতই জুন তারিখের বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যা বলেছেন তা হলো–
বাংলাদেশ হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।
এ বক্তৃতা থেকে শেখ মুজিবের ‘সর্বধর্মের প্রতি সদ্ভাবের সুর ধ্বনিত হলেও সেকুলারিজমের মূল সুরটি অনুধাবিত হয় নি। আর হয় নি বলেই, সেসময়কার সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদে ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ লোপ করা হলেও, প্রবণতা দেখা দিল রাষ্ট্রকর্তৃক সকল ধর্মকে সমান মর্যাদাদানে। তাই বেতারে, টেলিভিশনে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সর্বত্র কোরআন শরীফ, গীতা, বাইবেল আর ত্রিপিটক পাঠ করা হতে লাগলো এক সঙ্গে। এ আসলে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং ধর্ম আর শ্রদ্ধার মিশেল দেওয়া এক ধরনের জগাখিচুড়ি। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে ‘চম-ধর্মনিরপেক্ষতা’। যত দিন গেছে, ততই শেখ মুজিব এমনকি এই ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা থেকেও দূরে সরে গেছেন। তার শাসনামলের প্রান্তে প্রতিটি ভাষণেই মুজিব ‘আল্লাহ’, ‘বিসমিল্লাহ’, ‘ইনশাল্লাহ’, ‘তওবা” প্রভৃতি শব্দ উচ্চারণ করতেন। এমনকি শেষদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক প্রতীক ‘জয় বাংলা’ও বাদ দিয়ে ‘খোদা হাফেজ’ প্রবর্তন করেন। শুধু তাই নয়, যে। ‘ইসলামিক অ্যাকাডেমি’ মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদরদের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল, তারও পুনরুত্থান ঘটান শেখ মুজিব এবং প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ফাউন্ডেশন’-এ উন্নীত করেন।
তাও কাগজে কলমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে যাওবা চালু ছিল মুজিবের সময়, জিয়াউর রহমান এসে তা মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেললেন। ধর্মনিরপেক্ষতার উপরে কাঁচি চালিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ আর সমান বেগে মূলনীতি হিসেবে স্থাপিত হলো ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা আর বিশ্বাস’কে। সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদ-এর উচ্ছেদ হয়ে গেল। ১২ নং অনুচ্ছেদের উচ্ছেদের ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। এরশাদ সাহেব এসে তো ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মই বানিয়ে দিলেন। এরপর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তো অচ্ছুৎ হয়েছেই, বরং পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে ধর্মকে তোষণ করে চলার নীতি। বিগত জোট সরকারের আমলে ধর্মকে আর মৌলবাদকে তোষণ করার ফলস্বরূপ কীভাবে বাংলা ভাইযের উত্থান হয়েছিল, কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিল, কীভাবে প্রতিটি জেলায়, সিনেমা হলে, মাজারে, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমাবাজির মহড়া চালানো হয়েছিল তা আমরা সবাই দেখেছি।
জনগণকে ইহজাগতিকতায় উদ্বুদ্ধ করার কাজ অতীতের শাসকেরা করে নি, এখনকার শাসকেরাও করছেন না। মোহাম্মদ বিড়াল’ নিয়ে আলপিন নাটক আর তার পরিসমাপ্তি বায়তুল মোকারমের খতিবের কাছে গিযে ক্ষমা প্রার্থনার মহড়া আমরা দেখেছি কিছুদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এতদিন রাষ্ট্রীয় বিবাদ-বিপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সংসদভবন, বঙ্গভবন এগুলো ছিল উপযুক্ত এবং নির্বাচিত স্থান। আমাদের অতি বুদ্ধিমান রাষ্ট্রের কর্ণধাররা সেটিকে সংসদ ভবনের বদলে বায়তুল মোকারমের বৈঠকখানায় নিয়ে উঠালেন। পরে দেখলাম, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের পরিবর্তে অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষিত মোল্লাগোষ্ঠীকে তোষণ করে চললেন সেসময়কার শাসকেরা। দেখেছি ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে ফেসবুক বন্ধের নাটক এবং তারপর আবার জনদাবির মুখে খুলে দেওয়ার নির্লজ্জ তামাসা।