হিটলার-স্ট্যালিনের ব্যাপারটা আরও সরলভাবে বোঝানো যায়। স্ট্যালিন এবং হিটলার দুজনেরই গোঁফ ছিল। এখন কেউ যদি যুক্তি দেন গোঁফ থাকার জন্যই তারা গণহত্যা করেছেন, কিংবা গোঁফওয়ালা ব্যক্তিরাই গণহত্যা করে-এটা শুনতে যেমন বেখাপ্পা এবং হাস্যকর শোনাবে, ঠিক তেমনই হাস্যকর শোনায় কেউ যখন বলেন, নাস্তিকতার জন্যই কেউ স্ট্যালিন বা হিটলারের মতো গণহত্যা করেছেন।
.
সেকুলারিজম মানে কি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা?
এই গ্রন্থের দুই লেখককেই মুক্তমনাসহ অন্যান্য ব্লগে বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে লিখতে, আলোচনা করতে এবং বিতর্কে অংশ নিতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিও মাঝে মধ্যে চলে আসে। বিতর্ক করতে গিয়ে অনেকের কাছ থেকেই যা শোনা যায় তা হলো, সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের মানে হচ্ছে সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। এমনকি যারা ধর্ম মানেন না, এবং উদারপন্থী বলে কথিত তাদের অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে এভাবে দেখেন।
বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। সেকুলার শব্দের মানে কি সত্যিই সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা? অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মতো দেশগুলোতে এখন তা-ই প্রচার করা হয়। বিভ্রান্তি সে কারণেই। আসলে কিন্তু ‘সেক্যলারিজম’ শব্দটির অর্থ ‘সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিত। আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারিতে secularism শব্দটির সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এভাবে–
The view that religious considerations should be excluded from civil affairs or public education
এ সংজ্ঞা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ধর্মকে রাষ্ট্রের কাজের সাথে জড়ানো যাবে না এটাই সেকুলারিজমের মোদ্দা কথা। ধর্ম অবশ্যই থাকতে পারে, তবে তা থাকবে জনগণের ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে প্রাইভেট ব্যাপার হিসেবে; ‘পাবলিক’ ব্যাপার স্যাপারে তাকে জড়ানো যাবে না।
ভারত তার জন্মলগ্ন থেকেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে এসেছে (যদিও ভারতের সংবিধানে ‘অফিশিয়ালি’ ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অনেক পরে)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সেকুলারিজমের প্রকৃত সংজ্ঞা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন অনেক ভালোভাবে। তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী থেকে ধর্মকে পৃথক রাখাই সংগত মনে করতেন, জাতীয় জীবনে সব ধর্মের প্রতি উদাসীন থাকাটাই তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো। তিনি বলতেন–
ধর্ম বলতে যে ব্যাপারগুলোকে ভারতে কিংবা অন্যত্র বোঝানো হয়, তার ভয়াবহতা দেখে আমি শক্ষিত এবং আমি সবসময়ই তা সোচ্চারে ঘোষণা করেছি। শুধু তাই নয়, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে এ জঞ্জাল সাফ করে ফেলাই ভালো। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধর্ম দাঁড়ায় ধর্মান্ধতা, প্রতিক্র্যিাশিলতা, মূঢ়তা, কুসংস্কার আর বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিভূ হিসেবে।
আমেরিকার ‘ফাউন্ডিং ফাদার’দের মাঝে নেহেরুর অনুপ্রেরণা ছিল কিনা জানি না, তবে তারা আমেরিকার সংবিধান তৈরির সময় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা রেখেছিলেন, খুব বলিষ্ঠ ভাবে[৩৩৯]–
As the Government of the United States of America is not, in any sense, founded on the Christian religion; as it has in itself no character of enmity against the laws, religion, or tranquility, of Musselmen; and as the said States never have entered into any war or act of hostility against any Mehomitan nation, it is declared by the parties that no pretext arising from religious opinions shall ever produce an interruption of the harmony existing between the two countries. (ref. The Treaty of Tripoli, drafted in 1796 under George Washington, and signed by John Adams in 1797)
আসলে অভিধানে secular শব্দটির অর্থও করা হয়েছে 2015 ‘Worldly rather than spiritual’ সেকুলারিজমের অন্যান্য প্রতিশব্দগুলো হলো worldly, temporal কিংবা profanel শব্দার্থগুলো খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এর অবস্থান ধর্ম কিংবা আধ্যাত্মিকতার দিকে নয়, বরং এর একশ আশি ডিগ্রি বিপরীতে। সেজন্য, সেকুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ অনেকে খুব সঠিকভাবেই করেন ‘ইহজাগতিকতা।
অথচ সেই ‘ইহজাগতিক’ ভারতেই রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণ পঞ্চাশের দশকে ঘোষণা করলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় বরং সর্ব ধর্মের সহাবস্থান, এবং Hindu view of life-এর কল্পিত ভাববাদী পূর্ণতায় তিনি আস্থাবান। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’-এই শ্লোগানটি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী দল আওয়ামী লীগও খুব জোরেশোরে বলার চেষ্টা করে। তবে এ শ্লোগানটির মধ্যেই রয়েছে এক ধরনের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। এ ফাঁকিটি চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘ইহজাগতিকতার প্রশ্ন’ প্রবন্ধে। এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে অভিজিৎ রায় আর সাদ কামালীর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ (চারদিক, ২০০৮) বইয়ে–
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এই কথাটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই খুব জোরেশোরে বলা হচ্ছে। কথাটা সত্য বটে আবার মিথ্যাও বটে। সত্য এ দিক থেকে যে, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা নাগরিকদের এ পরামর্শ দেয় না যে, তোমাদের ধর্মহীন হতে হবে; কিন্তু তা বলে এমন কথাও বলে না যে, রাষ্ট্র নিজেই সকল ধর্মের চর্চা করবে, কিংবা নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম চর্চায় উৎসাহিত করবে। রাষ্ট্র বরঞ্চ বলবে ধর্মচর্চার ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিজের কোনো আগ্রহ নেই, রাষ্ট্র নিজে একটি ধর্মহীন প্রতিষ্ঠান। ধর্ম বিশ্বাস নাগরিকদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রের ওই ধর্মহীনতাকেই কিছুটা নম্রভাবে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা।