মানবসভ্যতার সূচনা পর্বে ধর্ম ছিল জাদুবিদ্যা কেন্দ্রিক, অনেক নবী পয়গম্বর ছিলেন আসলে জাদুকর। বহুকাল আগে, সাভানা অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের এক গোত্রের কথা চিন্তা করা যাক। গোত্রের সব মানুষের সামনে একজন সামান, জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিলেন মুঠোভর্তি কালো গুড়ো। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বিস্ফোরণে আগুনের শিখা উপরে উঠে গেল। দর্শকদের কাছে ঘটনাটি গণ্য হলো জাদু হিসেবে। এবং এই ‘অতিপ্রাকৃত ঘটনা সবার সামনে ঘটানোর জন্য সামান নিজেকে দাবি করলেন সবার চেয়ে আলাদা। একজন, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যেতে পারে সামানদের দৃষ্টান্তকে। সামান গোত্রভুক্তরা তাদের মনে থাকা অসংখ্য প্রশ্ন ও বিভিন্ন ঘটনা কে ঘটাচ্ছেন এমন প্রশ্নের উত্তর না পেযে দ্বারস্থ হতেন জাদুকর সামানদের কাছে। ইচ্ছা ছিল পেছনে থাকা একজনকে খুঁজে বের করা-যার ইশারায় ঝড় থেমে যায়, যার ইশারায় তারা খাবারের সন্ধান পায়, যার ক্রোধে মহামারীতে তাদের শত্রুপক্ষের অর্ধেকেরও বেশি লোক হুট করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে আমরা দেখতে পাই, সামানরা নিজেরাও আলাদা কেউ ছিলেন না, তাদের জাদুটাও সত্যিকার অর্থে জাদু নয়, রাসায়নিক বিক্রিয়া। সামানরা নিজেদের ক্ষমতা ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বানিয়ে বানিয়ে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, গোত্রের সবাই মাথা নত করে তার কথা মেনে নিতো। কখনও সূর্য, কথনও দূরে থাকা কোনো পাহাড়কে পূজা করত।
প্রথমদিকে, মানুষ ছোট ছোট গোত্রে বাস করত। তখন থেকেই সমঝোতা, ইট-মারলে পাটকেল (tit-for tat), সততা, সহমর্মিতা, বিনিময়ী পরার্থতা (Reciprocal Altruism) প্রভৃতি মূল্যবোধ প্রায় সবার মধ্যেই ছিল। গরিলা, বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, হাতি, নেকড়ে এমনকি মৌমাছি, পিঁপড়ার মতো কিছু সামাজিক প্রাণীর মধ্যেও এই ধরনের কিছু মূল্যবোধের কম-বেশি উপস্থিতির ফলে আমরা নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারি, কোনো ঐশী প্রক্রিয়ায় মূল্যবোধগুলো মানবসমাজে উদ্ভূত হয় নি, বরং জৈবিক সামাজিক বিবর্তনের ফলস্বরূপ এগুলো বিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই উদ্ভূত হয়েছে মানুষের মধ্যে (আমরা এই বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি)। পরবর্তীকালে সমাজ আরও জটিল হয়েছে। সেই জটিলতা স্পর্শ করেছে নৈতিকতা আর মূল্যবোধগুলোকেও। যেমন, কৃষিকাজের ব্যাপক অগ্রগতির ফলে গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল একসময়, অপরিচিতের সাথে আদান-প্রদান, ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হওয়ায় দেখা গেল, আগেকার সেই ছোট গোত্রের মূল্যবোধে ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে না। এই কারণে সমাজপতি এবং নেতারা সবাইকে সংঘবদ্ধ রাখার জন্য আরও কিছু নিয়ম-কানুন সমাজে সংযুক্ত করা শুরু করলেন। তারা ভাবলেন, কেউ কিছু বললেই তো আর মানুষ শুনবে না, এই সংশযে কেউ কেউ সেই নিয়ম-কানুনগুলোকে ‘ঈশ্বর প্রদত্ত আইন’ বলে প্রচার করলেন। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘবদ্ধ ধর্মের সূচনা তাই কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরঞ্চ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই অঞ্চলগুলোয় কৃষিকাজের দ্রুত উন্নতি তৈরি করেছিল যাজক শ্রেণি। সেখানকার রাজারা নিজেদের প্রকাশ করতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। খ্রিস্টান রাজারা চার্চের সহায়তার কারণে যেকোনো কাজ করাকে স্বর্গীয় অধিকার বলে মনে করতেন। এধরনের ঘটনা আমরা অন্য অনেক জায়গায়ই দেখি। যেমন, চীনেও একসময় রাজাকে মানবসমাজের স্বর্গীয় প্রতিনিধি হিসেবে ভাবা হতো বহুদিন।
কীভাবে নতুন ধর্ম তৈরি হয়, কীভাবে ধর্মের অনুসারী তৈরি হয়, কীভাবে মানুষ নবী রাসুলকে বিশ্বাস করতে শেখে তা একটা চমৎকার উদাহরণের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা কিন্তু দেখিয়েছেন কার্গো কাল্ট (Cargo Cult) নিয়ে গবেষণা করে[৩৩১]। ‘কার্গো কাল্ট’ হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলোতে বর্তমান ধর্মবিশ্বাসগুলোর একটি সম্মিলিত নাম-যারা কার্গো জাহাজগুলোকে স্বর্গীয় দূতের পাঠানো সামগ্রী মনে করত। জাহাজের ইউরোপিয়ান নাবিকেরা কীভাবে রেডিও শোনে, কেন কোনো সারাইয়ের কাজ করতে হয় না, রাতে কী করে আলো জ্বালায়-এ সবই দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা অদ্ভুত বিস্ময়ে দেখত। তাদের কাল্টপ্রধান জন ফ্রাম চিরতরে চলে যাওয়ার আগে সেসময় অনেকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন দ্বিতীয়বারে জাহাজভর্তি সামগ্রী আনবে ও সাদা আমেরিকানদের চিরকালের মতো দ্বীপ থেকে বিতাড়িত করা হবে ইত্যাদি বলে। দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে আদিবাসীরা অপেক্ষা করে আছে জন কখন আসবে তাদের মুক্তি দিতে। আপনি কি তার সাথে মিল পান বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মুক্তি পাওয়ার জন্য পুনরুত্থিত যিশুখ্রিস্ট কিংবা ইমাম মাহাদির জন্য অপেক্ষাকে?
.
ধর্মের কুফল
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। মেহেদি রাঙ্গানো দাড়ির এই লোককে আমরা সবাই চিনি, বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান ‘আপনার জিজ্ঞাসা’র বদৌলতো এ মানুষটি সপ্তাহান্তে আমাদের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় উপদেশ দেন, কীভাবে চলতে হবে তার দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কীভাবে চলেছিলেন? এখনকার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, তখন পরিচিত ছিলেন খাড়াদ্যিার বাচ্চু নামে, তার নামে ভয়ে কাঁপতো ফরিদপুর এলাকা। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের বড় বাড়দিয়া গ্রামের প্রায় শতাধিক যুবককে নিয়ে তৈরি এই মিলিটারি বাহিনী স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল, ‘থাড়দিয়ার মেলিটারি’ নামে। পাক-বাহিনীর দোসর এই বাহিনী, খাড়দিয়ার আশেপাশের প্রায় ৫০ গ্রাম জনপদে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চালিয়েছিল তাণ্ডবলীলা। স্থানীয়দের বরাতে জানা যায়, এই বাচ্চু ও তার বাহিনী একাত্তরে নৃশংসভাবে হত্যা করে হাসামদ্যিার হরিপদ সাহা, সুরেশ পোদ্দার, মল্লিক চক্রবর্তী, সুবল ক্যাল, শরৎ সাহা, শ্রীনগরের প্রবীর সাহা, যতীন্দ্রনাথ সাহা, জিন্নাত আলী ব্যাপারী, মযেনদিয়ার শান্তিরাম বিশ্বাস, কলারনের সুধাংশু রায়, মাঝারদিয়ার মাহাদেবের মা, পুরুরার জ্ঞানেন, মাধব, কালিনগরের জীবন ডাক্তার, ফুলবাড়িয়ার চিত্তরঞ্জন দাস, ওয়াহেদ মোল্লা, দাল, মোতালেবের মা, যবদুল, বাদল নাথ, আস্তানার দরবেশসহ বিভিন্ন জনপদের প্রায় শতাধিক মানুষকে। ফতোয়া সম্পর্কিত হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়ের বিরুদ্ধে লিভ আবেদন কারী ও বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ বাচ্চুর বর্তমান অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, নগরকান্দা উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের নতিবদ্যিা গ্রামের শোভা রানী বিশ্বাস। একাত্তরে তিনি এই আবুল কালাম আজাদের কাছে হয়েছিলেন ধর্ষিত। এ গ্রামেরই নগেন বিশ্বাসের স্ত্রী দেবী বিশ্বাসেরও সম্ভ্রম লুটেছিলেন বাচ্চু। নতিবদিয়ার প্রবীণ দুই মৎস্যজীবী নকুল সরদার ও রঘুনাথ দত্ত ২০০০ সালে প্রকাশিত জনকণ্ঠের ‘তুই রাজাকার’ শীর্ষক ধারাবাহিক রিপোর্টের রিপোর্টার প্রবীর সিকদারকে জানান লুটপাট-হামলা না করার শর্তে আমরা চাঁদা তুলে বাচ্চুকে দু’হাজার চার শ’ টাকা দিয়েছিলাম। তারপরও সে লুটপাট করেছে, গ্রামের দুই নববধূকে ইজ্জত হরণ করেছে। পুরুরা গ্রামের জ্ঞানেন জীবন বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। বাচ্চু সেখানেই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বাচ্চুর রাইফেলের গুলিতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান ফরিদপুরের ফুলবাডিয়ার চিত্তরঞ্জন দাস। সেদিন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জ্যোৎস্না পালিয়ে রক্ষা পেলেও একাত্তরে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তার তিন শিশু সন্তান। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘদিন জ্যোৎস্না শুধু তার স্বামী হন্তারকের বিচার চেয়েছিলেন মনে মনে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে সাংবাদিক প্রবীর সিকদার দৈনিক জনকণ্ঠে বাচ্চুসহ ফরিদপুর অঞ্চলের রাজাকারদের নিয়ে ‘তুই রাজাকার’ শীর্ষক প্রামাণ্য সিরিজ প্রতিবেদন করায় তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র, গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়। এ হামলার পেছনে তখন কুখ্যাত রাজাকার নুলা মুসা ও বাঙুর ইন্ধনের অভিযোগ ওঠে[৩৩২]।