অতএব সঙ্গত কারণে আমার প্রতি আরোপিত এই অতিঘোর সন্দেহ ধর্মাবতারদের ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রত্যেকের মন হতে দূর করার উদ্দেশ্যে সরল অন্তঃকরণে ও অকপট বিশ্বাসে শপথ করে বলছি যে পূর্বোক্ত ভ্রান্ত ও ধর্মবিরুদ্ধ মত আমি ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করি। …আমি শপথ করে বলছি যে, আমার উপর এ জাতীয় সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, এরূপ কোনো বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যতে আর কখনও কিছু বলব না বা লিখব না এরূপ অবিশ্বাসীর কথা জানতে পারলে অথবা কারও ওপর ধর্মবিরুদ্ধ মতবাদ পোষণের সন্দেহ উপস্থিত হলে পবিত্র ধর্মসংস্থার নিকট অথবা যেখানে অবস্থান করব সেখানকার বিচারকের নিকট আমি তা জ্ঞাপন করব। শপথ নিয়ে আমি আরও প্রতিজ্ঞা করছি যে, এই পবিত্র ধর্মসংস্থা আমার ওপর যেসব প্রায়শ্চিত্তের নির্দেশ প্রদান করবে আমি তা হুবহু পালন করব। এসব প্রতিজ্ঞা ও শপথের যেকোনো একটি যদি ভঙ্গ করি তাহলে শপথভঙ্গকারীর জন্য ধর্মাধিকরণের পবিত্র অনুশাসনে এবং সাধারণ অথবা বিশেষ আইনে যেসব নির্যাতন ও শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব। অতএব ঈশ্বর ও যেসব পবিত্র গ্রন্থ আমি স্পর্শ করে আছি এরা আমার সহায় হোন। আমি উপরে কথিত গ্যালিলিও গ্যালিলি শপথ গ্রহণ ও প্রতিজ্ঞা করলাম এবং নিজেকে উপযুক্তভাবে বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে প্রতিশ্রুত হলাম। এর সাক্ষ্য হিসেবে স্বহস্তলিখিত শপথনামা যার প্রতিটি অক্ষর এইমাত্র আপনাদের পাঠ করে শুনিয়েছি তা আপনাদের নিকট সমর্পণ করছি। (২২শে জুন, ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ, রোমের মিনার্ভা কনভেন্ট)।
শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিযে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন-’তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরিন অবস্থায়। শুধু গ্যালিলিওকে অন্তরিন করে নির্যাতন তো নয়, ব্রুনোকে তো পুড়িয়েই মারলো ঈশ্বরের সুপুত্ররা। তারপরও কি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গেল?
শুধু গ্যালিলিও বা ব্রুনো নয়, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, হাইপেশিয়া, এনাক্সোগোরাস, ফিলিগ্রাস প্যারাসেলসাস, এনাকু সিমন্ড, লুসিলিও ভানিনি, টমাস কিড, ফ্রান্সিস কেট, বার্থেীলোমিউ, লিগেট, ইবনে খালিদ, জিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দী, আল রাজি কিংবা ইবনে রুশদসহ অনেককেই ধর্মান্ধদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়ে নিহত হতে হয়। মুক্তমনা লেখকেরা এধরনের নিপীড়নের অনেক পরিসংখ্যান হাজির করেছেন তাদের বইপত্রে[৩৩০]।
.
বিশ্বাসের উদ্ভব
বিশ্বাসের উদ্ভব সমাজে কীভাবে হলো তা বিভিন্ন আলোচক বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেন, করবেন, অতীতেও করেছেন। তবে আমরা-এ বইয়ের দুজন লেখক মনে করি, বিশ্বাসের পুরো ব্যাপারটিকে আসলে নৃতাত্বিক, সামাজিক এবং জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে বিষযের সম্পূর্ণতা আসে না। এ বইয়ে আমরা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিশ্বাসের উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করেছি,যা আধুনিককালে ধর্মসংক্রান্ত গবেষণার সবচাইতে অগ্রসর এবং সজীব ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। আমরা বইটি লিখতে গিয়ে বিশ্বাসের অবদানকে গায়ের জোরে অস্বীকার করি নি। আমরা আমাদের বইয়ে স্বীকার করেছি যে, ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটা মানব জাতির বেঁচে থাকার পেছনে হয়ত কোনো বাড়তি উপাদান যোগ করেছিল একটা সময়। মানুষ আদিমকাল থেকে বহু সংঘাত, মারামারি এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গিযে আজ এই পর্যায়ে এসে পোঁছেছে। একটা সময় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করাটা ছিল মানবজাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক। যে গোত্রে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারা গিয়েছিল যে যোদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলে পরলোকে গিয়ে পাবে অফুরন্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, হুর পরী উদ্ভিন্নযৌবনা চিরকুমারী অপ্সরা, (আর বেঁচে থাকলে তো আছেই সাহসী যোদ্ধার বিশাল সম্মান আর পুরস্কার)–তারা হয়ত অনেক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং নিজেদের এই যুদ্ধংদেহী জিন পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে।
এই বইয়ে আমরা মানবসভ্যতাকে শিশুদের মানসজগতের সাথে তুলনা করেছি। আমরা দেখিয়েছি, শিশুদের বেঁচে থাকার প্রযোজনেই একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকদের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয়। শিশুরা একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত তার অভিভাবকের কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে এবং পালন করে বলেই তারা বিপদ থেকে রক্ষা পায়, টিকে থাকতে পারে। কিন্তু শিশুটির অভিভাবকেরাই যথন অসংখ্য ভালো উপদেশের পাশাপাশি আবার কিছু মন্দ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশও দেয়, তখন শিশুর পক্ষে সম্ভব। হয় না সেই মন্দ বিশ্বাসকে অন্য দশটা বিশ্বাস কিংবা ভালো উপদেশ থেকে আলাদা করার। সেই মন্দবিশ্বাসও বংশপরম্পরায় সে বহন করতে থাকে অবলীলায়। সব বিশ্বাস খারাপ তা আমরা বলি নি, কিন্তু আমরা বলতে চেয়েছি, অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস হয়ত ভাইরাসের মতো একটা সময় প্রগতিকে থামাতে চায়, সভ্যতাকে ধ্বংস করে। ডাইনি পোড়ানো, সতীদাহ, বিধর্মী এবং কাফেরদের প্রতি ঘৃণা, মুরতাদদের হত্যা-এগুলোর উদাহরণ তো হাতের সামনেই আছে। এগুলো যে বিশ্বাসের প্রসারে বেড়ে ওঠা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছাড়া কিছু নয়, তাতে অনেকেই একমত হবেন। কীভাবে বিশ্বাস নির্ভর ব্যবস্থা টিকে আছে, কীভাবে আমরা বিশ্বাসগুলো বংশ পরম্পরায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেই তা বুঝতে হলে সামাজিক জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণাগুলোকে বুঝতে হবে। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে আর সুজান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে কীভাবে বিশ্বাস বংশপরম্পরায় টিকে থাকে অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন। আমরাও এই বইয়ের সপ্তম এবং অষ্টম অধ্যায়ে বিশ্বাসের আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হাজির করেছি।