বইটির আরেকটি মূল্যবান রিভিউ করেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী পদার্থবিজ্ঞানী এবং সুলেখক ড. প্রদীপ দেব। মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত ‘অবিশ্বাসের দর্শন: নবযুগের যুক্তিবাদীর দৃপ্ত পদক্ষেপ’ শিরোনামের এ রিভিউটিতে প্রদীপ দেব যে কথাগুলো উল্লেখ করেছিলেন তা আজও আমাদের জন্য নির্মল আনন্দ এবং অফুরন্ত প্রেরণার নৈমিত্তিক থোরাক”[২]
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব সামান্য সংখ্যক। কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন যাঁরা পৃথিবীটাকেই বদলে ফেলার চেষ্টা করেন। দিনের পর দিন নিরলস সংগ্রাম চেষ্টা পরিশ্রম অধ্যবসায় দিয়ে পৃথিবীটাকে একটু একটু করে ঠিকই বদলে ফেলেন এই ব্যতিক্রমী মানুষেরা। অথচ তার সুফল ভোগ করেন সবাই যাদের মধ্যে তাঁরাও আছেন যাঁরা ক’দিন আগেও এ পরিবর্তনের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। ধর্মবাদীদের সাথে মুক্তমনাদের পার্থক্য এখানেই যে ধর্মবাদীরা বড় বেশি বিভাজনপটু। ধর্মবাদীরা তাঁদের নিজস্ব ধর্মের অনুশাসনগুলোর প্রতি কেউ প্রশ্ন তুললেই সেটাকে ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না অনেক সময়। বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক যুক্তিতে টিকে থাকতে না পারলে পেশীশক্তি ব্যবহার করেন ধর্মবাদীরা। মধ্যযুগে ধর্মের প্রসার ঘটেছে তলোয়ারের আস্ফালনে, বর্তমানেও ধর্মবাদীদের মূল অস্ত্র আর যাই হোক—যুক্তি নয়। অথচ সারা পৃথিবীতে একজনও যুক্তিবাদী মুক্তমনা পাওয়া যাবে না যিনি যুক্তির বদলে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। যুক্তির শক্তি যে কত প্রবল তা আরো একবার বুঝতে পারলাম অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীরের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ পড়তে পড়তে।
তবে রিভিউটিতে ড.দেব অফুরন্ত প্রশংসাবাক্য প্রক্ষেপণের পাশাপাশি গুটিকয় দুর্বলতারও উল্লেখ করেছিলেন। বিশেষত কিছু লজ্জাজনক বানান এবং মুদ্রণপ্রমাদ গুরুত্বপূর্ণ বইটিকে লঘু করে দিয়েছিল নির্দ্বিধায় বলা যায়। যদিও প্রদীপ দেব রিভিউটি লিখেছিলেন বইটির প্রথম সংস্করণের উপর ভিত্তি করে, এবং তার দেওয়া প্রমাদের তালিকার অধিকাংশই ইতোমধ্যে পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে ফেলা হয়েছিল, তারপরেও কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা থেকেই গিয়েছিল। সেগুলোও এবারকার এই নতুন সংস্করণে সংশোধন করে দেয়া গেল। যেমন, ‘বিগব্যাঙ এর জায়গায় ‘বিগব্যাং’ করা হয়েছে, গণিতবিদ ‘ফিবোনাক্কি’র নাম মূল ইতালীয় উচ্চারণ অনুসরণ করে ‘ফিবোনাচি করা হয়েছে। ফিবোনাচি সিরিজে (০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫) মাঝখানের একটি সংখ্যা (১) বাদ পড়েছিল। সেটা যোগ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরণের ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি সংশোধনের পাশাপাশি নতুন নতুন তথ্যের আলোকে পূর্ববর্তী কিছু অনুচ্ছেদ রদবদল করা হয়েছে। বিশেষত লরেন্স ক্রাউসের ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ গ্রন্থটির প্রকাশ (বাংলাতেও প্রকাশিত হতে চলেছে অভিজিৎ রায় এবং মীজান রহমানের ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব[৩]), মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণের সাফল্য প্রভৃতি ঘটনা মহাবিশ্বের উৎপত্তির পেছনে স্ফীতিতত্ত্বের অনুমানকে আরো জোরালো করেছে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ অধ্যায়ের ‘প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে’ অংশটি বিবর্ধিত করা হয়েছে।
বইটির বেশ কিছু জায়গায় নতুন তথ্য এবং রেফারেন্স যোগ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি,নতুন সন্নিবেশগুলো বইটির মানের উন্নয়ন যেমন ঘটাবে, সেইসাথে সর্বাধুনিক এ তথ্যগুলো পাঠকদের চিন্তার খোরাকও যোগাবে পুরোদমে।
অবিশ্বাসের দর্শনের নতুন এ সংস্করণটি বইটির তৃতীয় সংস্করণ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ২০১২ সালে প্রকাশিত বইটি পেপারব্যাক সংস্করণের সহস্রাধিক কপি প্রকাশিত হয়েছিল। এক বছরের মাথায় বইটির সকল কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও পূর্ববর্তী প্রকাশকের (শুদ্ধস্বর) ব্যর্থতায় বইটি দীর্ঘদিন ধরেই ‘আউট অব প্রিন্ট’। শুধু তাই নয়, একটা সময় পর শুদ্ধস্বরের সত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল বইটির পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশে অপারগতার কথা জানিয়ে দিলে আমরা নিরুপায় হয়ে বইটি প্রকাশের ভার তুলে দিয়েছি জাগৃতি প্রকাশনীর হাতে প্রকাশনার জগতে জাগৃতি একটি পরিচিত এবং বিশ্বস্ত নামা জাগৃতির সত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনের হাত দিয়ে ইতোমধ্যেই বের হয়েছে বহুল আলোচিত ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ গ্রন্থটি[৪]। পাঠকপ্রিয় এ গ্রন্থটির জন্য হুমকি ধামকি কম পোহাতে হয়নি লেখক এবং প্রকাশককে রকমারি ডট কম নামে একটি অনলাইন গ্রন্থ-বিপণন প্রতিষ্ঠান তো এক মুখচেনা লুম্পেনের জিহাদি হুমকির মুখে নতি স্বীকার করে বইটিকে তাদের স্টোর হতে সরিযেও নিয়েছেন। এর কিছুটা রেশ ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির উপরেও পড়েছিল। অনেকেই বইটির ভাগ্য নিয়ে ছিলেন চিন্তিত। আমাদের বইয়ের নতুন প্রকাশক অবশ্য সেই সব মৌলবাদী আস্ফালনে ভীত না হয়ে এ ধরণের ‘নাফরমানি’ বই আরো প্রকাশের অঙ্গীকার করেছেন; অবিশ্বাসের দর্শনের পাণ্ডুলিপির জন্য জন্য নিয়মিতভাবে তাগাদা দিয়ে চলেছেন। তার এই নিঃসীম তাগাদার ফসল এই অবিশ্বাসের দর্শনের নতুন সংস্করণ। দীপনের নিষ্ঠা,আগ্রহ,উদ্যম এবং সদিচ্ছা বইটিকে নতুন মাত্রা দেবে বলে আমরা মনে করছি।