বিশ্বাসে মিলায় দারিদ্র্য, অবিশ্বাসে বহুদূর!
.
ভাইরাস প্রতিষেধক
তাহলে এই সন্ত্রাসের ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায় কী করে? ভাইরাস যে প্রতিরোধ করতেই হবে-এ নিয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ সভ্যতার ক্যান্সারে রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে। মুম্বাইয়ে ফিদাইন হানার পর পরই মুক্তমনায় লিখিত একটিপ্রবন্ধে ড. বিপ্লব পাল বলেছিলেন[৩২৫]–
রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ ইত্যাদির ধারণাগুলোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে-তখন মধ্যযুগীয় ধর্মগুলোর আত্মিক উন্নতির কিছু বাণী ছাড়া আর কিছুই আমাদের দেওয়ার নেই। সেই আত্মিক উন্নতির নিদান ধর্ম ছাড়াও বিজ্ঞান থেকেই পাওয়া যায়-তবুও কেউ আত্মিক উন্নতির জন্য ধার্মিক হলে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু ধর্মপালন যখন তার হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়বোধকে উস্কে দিচ্ছে-সেটা খুব ভয়ংকর। ধর্ম থেকে সেই বিষটাকে আলাদা করতে না পারলে, এগুলো আমাদের সভ্যতার ক্যান্সার হয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে।
অর্থাৎ, এ ভাইরাসকে না থামিয়ে বাড়তে দিলে একসময় সারা দেহটাকেই সে গ্রাস করে ফেলবে। অধ্যায়ের প্রথম দিকে দেওয়া ল্যাংসেট ক্লক প্যারাসাইট আক্রান্ত পিঁপড়ার উদাহরণের মতো মানবজাতিও একসময় করে তুলবে নিজেদের আত্মঘাতী, মড়ক লেগে যাবে পুরো সমাজে। তাই কি আমরা চাই?
না, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই তা চাইতে পারেন। তাহলে এই সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার অ্যান্টিবডি, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস প্রতিষেধকের। আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমার আপনার মতো বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। আমরা কিন্তু আসলেই মনে করি-এই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের মুক্তমনার মতো বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী সাইটগুলো; ভূমিকা রাখতে পারে বিশ্বাসের নিগড় থেকে বেরুনো মানবতাবাদী গ্রুপগুলো এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গ 26। দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার, দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর মতো সৎ সাহসের, দরকার আমার-আপনার সকলের সামগ্রিক সদিচ্ছার। আপনার আমার এবং সকলের আলোকিত প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমরা একদিন সক্ষম হব সমস্ত বিশ্বাসনির্ভর ‘প্যারাসাইটিক’ ধ্যান ধারণাগুলোকে তাড়াতে, এগিযে যেতে সক্ষম হব বিশ্বাসের ভাইরাসমুক্ত নিরোগ সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
ড. ড্যারেল রে যে কথাগুলো বলে তার গড় ভাইরাস’ বইটি শেষ করেছেন[৩২৭],সে কথাগুলো উচ্চারণ করে আমরাও সমাপ্তি টানবো এই অধ্যায়টির–
ভাইরাসমুক্ত জীবনের আস্বাদন কোনো সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, বরং একটি চলমান যাত্রাপথের নাম। আমরা সবাই এই ভাইরাস দিয়ে কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত এবং আমরা নিজেদের অজান্তেই বয়ে নিয়ে যাই অসুস্থ বিশ্বাস, মতামত কিংবা ধারণা। শিশু বয়সেই ধর্মীয় বিশ্বাসের পানপাত্র হাতে তুলে দিয়ে আমাদের অনেকের মাথাই আক্রান্ত করে ফেলা হয়েছে। আক্রান্ত মননকে প্রতিষেধক দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে ফেলাই হবে আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য। আমরা যদি ঈশ্বর-ভাইরাসের কুফলগুলো সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকতে পারি, তবেই আমরা ভাইরাসমুক্ত সমাজ প্রত্যাশা করতে পারি।
আমাদের ধারণা, নতুন দিনের নাস্তিকেরাই ভাইরাস মুক্ত সমাজ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। আর নতুন দিনের নাস্তিকদের ক্রমিক প্রচেষ্টার কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হবে পরের অধ্যায়ে।
০৯. নতুন দিনের নাস্তিকতা : আগামী দিনের ভাইরাস-মুক্ত সমাজ
ঈশ্বর খুবই ভঙ্গুর; বিজ্ঞানের ছোট্ট একটি ফুলকি অথবা একটু সাধারণ জ্ঞানই তাকে মেরে ফেলতে সক্ষম। –চ্যাপম্যান কোযেন
বিশ্বাসের দীনতা
১৬৩৩ সাল। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে-বাইবেল বিরোধী এই সত্য কথা বলার অপরাধে চার্চ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করল ‘ধর্মদ্রোহিতা’র অভিযোগে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুজ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙে সবার সামনে জেড হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক-পৃথিবী স্থির অনড় সৌর জগতের কেন্দ্রে[৩২৮]। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। পোপ ও ধর্মসংস্থার সম্মুখে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞান সাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিল[৩২৯]–
আমি ফ্লোরেন্সবাসী স্বর্গীয় ভিন্সেঞ্জিও গ্যালিলিওর পুত্র, সত্তর বৎসর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলি সশরীরে বিচারার্থ আনীত হয়ে এবং অতি প্রখ্যাত ও সম্মানার্য ধর্মযাজকদের (কার্ডিনাল) ও নিখিল খ্রিস্টীয় সাধারণতন্ত্রে ধর্মবিরুদ্ধ আচরণজনিত অপরাধের সাধারণ বিচারপতিগণের সম্মুখে নতজানু হয়ে স্বহস্তে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ-পর্বক শপথ করছি যে, রোমের পবিত্র ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম সংস্থার দ্বারা যা কিছু শিক্ষাদান ও প্রচার করা হয়েছে ও যা কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছে আমি তা সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি, এখনও করি এবং ঈশ্বরের সহায়তা পেলে ভবিষ্যতেও করব। সূর্য কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও নিশ্চল এরূপ মিথ্যা অভিমত যে কীরূপ শাস্ত্রবিরোধী সেসব বিষয় আমাকে অবহিত করা হয়েছিল; এ মিথ্যা মতবাদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে এর সমর্থন ও শিক্ষাদান থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত থাকতে আমি এই পবিত্র ধর্মসংস্থা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে একই নিন্দিত ও পরিত্যক্ত মতবাদ আলোচনা করে ও কোনো সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে সেই মতবাদের সমর্থনে জোরালো যুক্তিতর্কের অবতারণা করে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করেছি। এজন্য গভীর সন্দেহ এই যে আমি খ্রিস্টধর্মবিরুদ্ধ মত পোষণ করে থাকি। ….