‘‘হোমার বাল্মীকির রামায়ণের একটা ভাবানুবাদ করেছিলেন-যার নাম ইলিয়াডা’ ‘প্লেটো ও হেরোডোটাসের মতে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ভারতীয় ভাবধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
‘গরু আমাদের সকলের মাতৃস্থানীয়, গরুর শরীরে ভগবান বিরাজ করেন।
একই স্কুলের ভারতের ম্যাপে ভারতকে দেখানো হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, তিব্বত এমনকি মায়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে বলা হয় অশোকের অহিংস নীতির ফলে তার সেনাবাহিনী যুদ্ধে উৎসাহ হারিয়েছিল। আলেকজান্ডার নাকি পুরুর কাছে যুদ্ধে হেরে গিযে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন।
মধ্যযুগের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার উগ্ররূপ আর বেশি প্রকট। সমগ্র ইতিহাস শিক্ষায় মুসলিমদের বিদেশি শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছেঃ
‘ভারতে বিদেশি মুসলিম শাসন
‘ভারতে তলোয়ার ধরে ইসলামের প্রচার হয়েছিল। মুসলিমেরা এক হাতে কোরআন আরেক হাতে তরবারি নিয়েই এসেছিল এদেশে … আমরা তাদের পরে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আমাদের যে ভাইযেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।”
‘হিন্দুরা চরম অপমানের সাথে তুর্কি শাসন মেনে নিয়েছিল।
‘বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, পর্দাপ্রথাসহ আরও অনেক কুসংস্কার মুসলিম রাজত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দুসমাজে স্থান করে নিয়েছে’
‘শিবাজী আর রানা প্রতাপ ছিলেন প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী। তারা মুসলিমদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্যই লড়াই করেছিলেন।’’
ভারতের স্কুলের পাঠ্য পুস্তকগুলোতে বিন কাশিম, ঘৌরী বা গজনীর মাহমুদ বা তৈমুর লং কীভাবে হিন্দুদের হত্যা করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা হাজির করে বাচ্চাদের মাথায় অঙ্কুরেই ‘মুসলিম বিদ্বেষ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। দেশ বিভাগের জন্য একতরফাভাবে মুসলিমদের দায়ী করে ইতিহাস লেখা হয়। আর. এস. এস-এর মতো সন্ত্রাসবাদী সাম্প্রদায়িক দলকে প্রকৃত স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হয়। সব থেকে মজার কথা, মহাত্মা গান্ধী যে এই সংগঠনের একজনের হাতেই মারা গিয়েছিলেন, সেকথাও বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে, পাঠক্রম এমনভাবে সাজানো যাতে সবার মধ্যে ভাব সৃষ্টি হয় যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলিম ও খ্রিস্টানদের হাতে অত্যাচারিত। তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব বর্তায় তার প্রতিশোধ নেওয়ার।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর সেইদিন প্রায় ৫০ জন জঙ্গি মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসবাদের যে তুঘলকি কাণ্ড শুরু করেছিল সেদিন এই বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে আমরা মুক্তমনায় দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। বিশ্বাসের বাইরেও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যুসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল বিস্তৃত পরিসরে উঠে এসেছিল কাশ্মীর প্রসঙ্গ, উঠে এসেছিল ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের নানা উদাহরণ। এটা ঠিক যে, কাশ্মীরী জনগণের ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাগাতার অত্যাচার, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের ওপর যে ধরনের অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে তা ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। মুসলিমরা ভারতের জনগণের প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ তারাই ভারতে সবচেয়ে নিপীড়িত, অত্যাচারিত এবং আর্থসামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী। এ সমস্ত অনেক কারণ মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করেছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু এটাও ঠিক, পৃথিবীতে সামাজিক অবিচার যেমন আছে, তেমন আছে সামাজিক অবিচারের নামে অন্ধবিশ্বাসের চাষ এবং তার প্রচার। ধর্মগ্রন্থের জিহাদি বাণীগুলো কিংবা সুচতুর উপায়ে বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে মগজ ধোলাইযের উদাহরণগুলো এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব জামান আমাদের সাইটে প্রবন্ধটি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যা বলেছেন তা হয়ত অনেকের মনেই চিন্তার খোরাক জোগাবে। তিনি বলেন–
মানুষের কোনো কোনো স্বভাব যেমন উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় বিশেষ কোনো বংশাণুর পরিস্ফুটনের কারণে সৃষ্ট হয়, তেমনই মৌলবাদী সন্ত্রাসও ঘটতে পারে কোনো কোনো ধর্মীয় আদেশাবলীর উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় পরিস্ফুটিত হওয়ার কারণে। এই উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করতে পারে অনেক কারণ, যার মধ্যে সামাজিক অনাচার অবশ্যই অন্যতম। কিন্তু শুধু সামাজিক অনাচার থাকলেই যে মৌলবাদী সন্ত্রাস ঘটবে এটা নিশ্চিত না। বংশাণুর মতো একটা মূল কারণও থাকতে হবে (মৌলবাদী সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে যা হতে ধর্মগ্রন্থের কোনো কোনো শ্লোক, কিংবা জাতিবিদ্বেষী বিকৃত ইতিহাস চর্চা)। আর এই ধর্মীয় বংশাণু কেবল সামাজিক অনাচারেই পরিস্ফুটিত হয়-তাও হলফ করে বলা যাবে না। কোনো কোনো ধর্মের আদেশাবলী এতই শক্তিশালী যে বিভিন্ন পরিস্ফুটক পরিবেশ অতি সহজেই সৃষ্ট হয় আদেশাবলীর জোরালো তাগিদেই। আর ধর্মীয় মূল কারণ না থাকলে সামাজিক অনাচার অন্যরকম সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। আবার নাও দিতে পারে।
থাইল্যান্ডে অতি গরিব বৌদ্ধরা ভিক্ষা করবে কিন্তু কখনও হিংসায় লিপ্ত হবে না। অনেক গরিব লোক চরম দারিদ্রের মধ্যেও সততা বিসর্জন দেয় না। তিব্বতিদের ওপর অত্যাচার হয়েছে অনেক বেশি। কিন্তু তিব্বতের লোকেরা হিংসার আশ্রয় নিয়ে সন্ত্রাসবাদী হয় নি। কাজেই এটা কখনোই বলা যায় না যে সামাজিক অনাচারই ধর্মীয় সন্ত্রাসের মূল কারণ, বরং বলা যায় অনুঘটক মাত্রা।