ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আবারও ফিরে তাকাই। ইসলামি সন্ত্রাসবাদ লালন-পালনে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিশাল অবদান আছে, এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু তারপরেও কেবল আমেরিকার দিকে অঙ্গুলি তুলে ধর্মগ্রন্থগুলোকে কখনোই ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ বানানো যায় না। ধর্মগ্রন্থের যে অংশগুলোতে জিহাদের কথা আছে (২ : ২১৬, ২ : ১৫৪), উদ্ভিন্নযৌবনা হুরিদের কথা আছে (৫২ : ১৭-২০, ৪৪ : ৫১-৫৫, ৫৬ : ২২), ‘মুক্তা সদৃশ’ গেলমানদের কথা আছে (৫২ : ২৪, ৫৬ : ১৭, ৭৬ : ১৯) সেসমস্ত ‘পবিত্র বাণীগুলো ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে কিংবা বছরের পর বছর। সৌদি পেট্রোডলারে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা নামক আগাছার চাষ করে বিভিন্ন দেশে তরুণ সমাজের কিছু অংশের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাসের ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে। ফলে এই ভাইরাস-আক্রান্ত জিহাদিরা স্বর্গের ৭২টা হুর-পরীর আশায় নিজের বুকে বোমা বেঁধে আত্মাহুতি দিতেও আজ দ্বিধাবোধ করে না; ইহুদি, কাফের, নাসারাদের হত্যা করে ‘শহীদ’ হতে তারা কার্পণ্যবোধ করে না। ল্যাংসেট ফুক প্যারাসাইটের মতো তাদের মনও কেবল একটি বিশ্বাস দিয়ে চালিত অমুসলিম কাফেরদের হত্যা করে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করতে হবে, আর পরকালে পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা আয়তলোচনা হুর পরীর লোভনীয় পুরস্কার। তারা ওই ভাইরাস আক্রান্ত পিঁপড়ার মতো হামলে পড়ছে কখনও টুইন টাওয়ারে, কখনও রমনার বটমূলে কিংবা তাজ হোটেলে।
কীভাবে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয়, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আধুনিক মিম তত্বকে। মিম নামের পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে, তার বিখ্যাত বই ‘দ্য সেলফিশ জিন’-এ[৩০৯]। আমরা তো জিন-এর কথা ইদানীং অহরহ শুনি। জিন হচ্ছে মিউটেশন, পুনর্বিন্যাস ও শারীরবৃত্তিক কাজের জন্য আমাদের ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য একক। সহজ কথায়, তিন জিনিসটা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের অখণ্ড একক যা বংশগতিয় তথ্যকে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়। জিন যেমন আমাদের শারীরবৃত্তীয় তথ্য বংশ পরম্পরায় বহন করে, ঠিক তেমনই সাংস্কৃতিক তথ্য বংশপরম্পরায় বহন করে নিয়ে যায় ‘মিম। কাজেই ‘মিম’ হচ্ছে আমাদের ‘সাংস্কৃতিক তথ্যের একক’, যা ক্রমিক অনুকরণ বা প্রতিলিপির মাধ্যমে একজনের মন থেকে মনান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেভাবে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের একক জিন ছড়িয়ে পড়ে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। যে ব্যক্তি মিমটি বহন করে তাদের মিমটির ‘হোস্ট’ বা বাহক বলা যায় ‘মিমপ্লেক্স’ হলো একসাথে বাহকের মনে অবস্থানকারী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একদল ‘মিম। কোনো বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কোনো দেশীয় সাংস্কৃতিক বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ-এগুলো সবই মিমপ্লেক্সের উদাহরণ। সুজন ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে মিমপ্লেক্সের অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন। সুজান ব্ল্যাকমোর মনে করেন জিন এবং মিমের সুগ্রন্থিত সংশ্লেষই মানুষের আচার ব্যবহার, পরার্থতা, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, রীতি-নীতি কিংবা কুসংস্কারের অস্তিত্বকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। মিম নিয়ে মুক্তমনা সাইটে দিগন্ত সরকার বাংলায় চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, সেটি রাখা আছে মুক্তমনায় প্রকাশিত ই-বই ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়’-এ[৩১০]। এই ই-বইটিতে দিগন্ত সরকার ধর্মের উৎস সন্ধানে নামের বাংলা প্রবন্ধটিতে মিমবিন্যাসের আলোকে ধর্মের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা মূলত ডকিন্স এবং সুজন ব্ল্যাকমোরের মিম নিয়ে আধুনিক চিন্তাধারারই অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ[৩১১]। সম্প্রতি মুক্তমনা ব্লগে ব্লগার স্বাধীন একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন ‘জিন এবং মিম’ শিরোনামে। তিনিও তার প্রবন্ধের মাধ্যমে মিমের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন বাঙালি পাঠকদের জন্য। এছাড়া অন্য বাংলা ব্লগগুলোতেও সম্প্রতি মিম নিয়ে ভালো লেখা উঠে আসছে।
কোনো সাংস্কৃতিক উপাদান কিংবা কোনো বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস কীভাবে মিমের মাধ্যমে জনপুঞ্জে ছডিযে পড়ে? মানুষের মস্তিষ্ক এক্ষেত্রে আসলে কাজ করে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার যেভাবে কাজ করে অনেকটা সেরকমভাবে। আর মিমগুলো হচ্ছে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মধ্যে ইন্সটল করা সফটওয়্যার যেন। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সফটওয়্যারগুলো ভালোমতো চলতে থাকে ততক্ষণ তা নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা থাকে না। কিন্তু কখনও কখনও কোনো কোনো সফটওয়্যার ভালো মানুষের (নাকি ‘ভালো মিমের’ বলা উচিত) ছদ্মবেশ নিয়ে ট্রোজান হর্স’ হয়ে ঢুকে পড়ে। এরাই আসলে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো। এরা সুচ হয়ে ঢোকে, আর শেষ পর্যন্ত যেন ফাল হয়ে বেরোয়। যতক্ষণে এই ভাইরাসগুলোকে শনাক্ত করে নির্মূল করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়-ততক্ষণে আমাদের হার্ডওয়্যারের দফারফা সারা। এই বিশ্বাসের ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারায় শত সহস্র মানুষ-কখনও নাইন-ইলেভেনে, কথনোবা বাবরি মসজিদ ধ্বংসে, কখনোবা তাজ হোটেলে গোলাগুলিতে। Viruses of the Mind শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স দেখিয়েছেন কীভাবে কম্পিউটার ভাইরাসগুলোর মতোই আপাত মধুর ধর্মীয় শিক্ষাগুলো সমাজের জন্য ট্রোজান হর্স কিংবা ওয়ার্ম ভাইরাস হিসেবে কাজ করে তিলে তিলে এর কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। আরও বিস্তৃতভাবে জানবার জন্য পাঠকেরা পড়তে পারেন সাম্প্রতিক সময়ে রিচার্ড ব্রডির লেখা ‘ভাইরাস অফ মাইন্ড কিংবা ক্রেগ জেমসের লেখা ‘দ্য রিলিজিয়ন ভাইরাস’ নামের বইগুলো[৩১২]। এ বইগুলো থেকে বোঝা যায় ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিষ্ক কী শান্তভাবে রোবটের মতো ধর্মের আচার আচরণগুলো নির্দ্বিধায় পালন করে যায় দিনের পর দিন, আর কখনো-সখনো বিধর্মী নিধনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে; একসময় দেখা দেয় আত্মঘাতী হামলা, জিহাদ কিংবা ক্রুসেডের মহামারী।