একটা প্রশ্ন আমাদের বরাবরই উদ্বিগ্ন করে। কেন এইসব তরুণ সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিচ্ছে? কেন তারা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী? কেন তারা ঘটনা তো একটা দুটো নয়, বিশ্বজুড়েই ঘটে চলেছে শত শত। বাংলাদেশেই কি আমরা কিছুদিন আগে বাংলা ভাইযের তাণ্ডব দেখি নি? ইসলামের নামে দেশের প্রতিটি জেলায় বোমাবাজি, কিংবা রমনা বটমূলে কিংবা সিনেমা হলগুলোর মতো ‘বে-শরিয়তী জায়গাগুলোর ওপর আগ্রাসন, চট্টগ্রাম আদালতে আত্মঘাতী বোমার তাণ্ডবে জগন্নাথ পাঁড়ের মৃত্যু, পত্রিকার পাতায় ঘাতকাহত হুমায়ুন আজাদ কিংবা ব্লগার থাবা বাবার রক্তাক্ত ছবি? ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের একুশ বছরের এক বাংলাদেশী যুবক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন[২৯৪] এগুলোর ভিত্তি কী? ২০০৫ সালের পর শুধু মুম্বাইযেই সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে অন্তত দশটি, যেগুলোর সাথে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। এর আগে রামজন্মভূমিকে ইস্যু করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সন্ত্রাস, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে দাঙ্গাও দেখেছি আমরা। এগুলোরই বা কারণ কী? এধরনের ঘটনা। ঘটলেই খুব জোরেশোরে একটি কারণকে সামনে নিয়ে আসা হয়: বিদ্যমান সামাজিক অনাচার। ২০০১ সালে সেপ্টেম্বর ১১-এর রক্তাক্ত ঘটনার পর পরই নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা নিজেই এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, যার কর্মকাণ্ডই নাইন-ইলেভেনকে নিজের ওপর টেনে এনেছে[২৯৫]। তবে সব বিশ্লেষকই যে চমস্কির ঢালাও মন্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন তা নয়। যেমন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস লিঙ্কন তার Holy Terrors, Thinking About Religion After September 11’ গ্রন্থে পরিষ্কার করেই বলেছেন[২৯৬]–
ধর্মের কারণেই আতা এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীরা মনে করেছে এধরনের আক্রমণ শুধু নৈতিক নয়, সেইসাথে পবিত্র দায়িত্ব।
আতা নিজেও তার সুটকেসে কোরআন বহন করছিলেন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত আতার কাছ থেকে পাওয়া তার শেষ নির্দেশাবলীগুলোও সেই সাক্ষ্যই দেয় যে, তারা পবিত্র আল্লাহ এবং ইসলামের প্রেরণাতেই এই জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন। সেই নির্দেশাবলীতে আতা খুব গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলেন-কীভাবে আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করতে হবে, কীভাবে অস্ত্র তৈরি রাখতে হবে, কীভাবে নিজের দেহকে কোরআনের আয়াত দিয়ে আশীর্বাদধন্য করে নিতে হবে, কীভাবে ঘটনা ঘটানোর সময় সুরা পাঠ করে যেতে হবে, ইত্যাদি[২৯৭]।
‘পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রভাব সাধারণ মানুষদের কাছে ব্যাপক, এমনকি এই আধুনিক সমাজেও। সেজন্যই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর অমানবিক আয়াত কিংবা শ্লোকগুলো সন্ত্রাস এবং সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে। সহিংসতার সাথে যে ধর্মের বাণীর অনেক সময়ই সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে তার ব্যাখ্যা জ্যাক নেলসন প্যালম্যের দিয়েছেন তার ইজ রিলিজিয়ন কিলিং আস?” গ্রন্থে [২৯৮]। তিনি বলেন–
Violence is widely embraced because it is embedded and sanctified in sacred texts and because its use seems logical in a violent world.
একই ধরনের কথা বলেছেন নতুন দিনের নাস্তিক স্যাম হ্যারিস তার নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার এন্ড অফ ফেইথ’ গ্রন্থে[২৯৯] তিনি তার বইয়ে দেখিয়েছেন অতিমাত্রায় মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নির্ভরতার কারণেই সন্ত্রাস আর জিহাদ এখনও করাল গ্রাসের মতো থাবা বসিয়ে আছে আমাদের সমাজে। তিনি মনে করেন আধুনিক সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরিখে মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নির্ভর ব্যবস্থা আজ অচল। এগুলো পরিত্যাগের সময় এসেছে আজ।
কিন্তু তারপরেও সামাজিক অনাচারের ব্যাপারটা থাকবেই। অনেক সময় সামাজিক অনাচার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়ন মিলেমিশে এমনই একাকার হয়ে যায় যে আলাদা করা মুশকিলই হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক যেমন হয়েছিল, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের মুম্বাইযে। সেইদিন প্রায় ১০জন জঙ্গি সবমিলিয়ে তাজ হোটেলসহ মুম্বাইযের ৫টা বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক আক্রমণ করে, গোলাগুলি করে নিমেষের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হামলায় দেড়শ জনেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল। ঘটনার পরপরই ডেকান মুজাহিদিন নামের একটি অজানা সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ লস্কর-ই-তৈয়বার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়[৩০০]। এছাড়াও আলকায়দা, জয়সে মুহাম্মদ, ভারতীয় মুজাহিদিন এবং সর্বোপরি অন্যান্য পাকিস্তানি টেরর গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনাও অনুমিত হয়েছে মিডিয়ায়। নিহত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পাঁচজন আমেরিকানসহ পনেরো জন বিদেশির মৃত্যুর ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়েছিল। সিএনএন পুরো দুই-তিন দিন ধরে ভারতের ঘটনাবলী সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। ঘটনার ভয়াবহতা এতই বেশি ছিল যে, অনেকেই ঘটনাটিকে ভারতের ৯/১১ হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছিলেন। নাইন ইলেভেনের ঘটনার সময় যেমনটি হয়েছিল, ঠিক তেমনই এসময়েও বহু বিশেষজ্ঞ এর পেছনে কাশ্মীর সমস্যা, সামাজিক অনাচার, মুসলিমদের প্রতি ভারতের বৈমাত্রেয় মনোভাবসহ বহু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সন্ধানে তৎপর হলেও এর পেছনে বড় একটা কারণ যে ধর্মীয় ছিল তা সন্দেহাতীত। মূলত হোটেল তাজের সেই সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামের লেখাটির সূত্রপাত ঘটেছিল এবং এটি মুক্তমনা এবং সচলায়তন ব্লগে প্রকাশের পর বহু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, উন্মোচন করেছিল পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার দুয়ার[৩০১]। বইয়ের এই অধ্যায়টি সেই প্রবন্ধেরই আনুষঙ্গিক বিস্তৃতি।