তারপর এলেন কাণ্ট। তিনি দেখলেন মধ্যযুগের পর দর্শনের ক্ষেত্রে কোলাহল যতই হোক না কেন, কাজ একটুও এগোয় নি। দর্শন ঘোলাজলের ডোবাই হয়ে রয়েছে; না এসেছে নিশ্চয়তা, না দেখা দিয়েছে অগ্রগতি। তার কারণ বিজ্ঞানের প্রকৃত রূপ যে কী তা বুদ্ধিবাদও ধরতে পারেনি, ইন্দ্রিয়বাদও নয়। এই দুই মতবাদই ভ্রান্ত কেননা উভয়েই অর্ধ্বসত্যকে পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণ করতে চায়। পদার্থবিজ্ঞান আর বিশুদ্ধ গণিত—দুইই বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান হিসেবে এদের মূল রহস্য একই। বিজ্ঞানের প্রকৃত প্রণালী—অতএব জ্ঞানের মূল উৎস—নিছক বুদ্ধিও নয়, নিছক ইন্দ্রয়সংবেদনও নয়, এ দুয়ের সার্থক সংশ্লেষণ। কথাটা কাণ্ট কি ভাবে প্রমাণ করেছেন সে আলোচনার অবসর এখানে নেই, মোটামুটি তাঁর মতবাদটুকু বলা যায়। তাঁর মতে মানব-মন ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়ে সংবেদন সংগ্রহ করে, কিন্তু এই ইন্দ্রিয়ের উপর ‘দেশ’ আর ‘কাল’ বলে দু রকমের মানসিক ঠুলি পরানো আছে; তাই যে সংবেদনই মনের কাছে পৌঁছাক না কেন তার উপর দেশ ও কালের ছোপ পড়ে যায়। অবশ্যই, এই দেশ ও কালের মধ্যে দিয়ে যে সংবেদন সংগ্রহ করা হয় সেটাই জ্ঞান নয়, জ্ঞানের মালমশলা মাত্র। শুধু মালমশলা স্তূপ করে রাখলেই তো ইরামত তৈরী হয় না—রাজমিস্ত্রী লাগিয়ে তা দিয়ে কাজ করাতে হয়। জ্ঞানের বেলাতেও ঠিক তাই : ইন্দ্রিয় বেদনগুলোর উপর বুদ্ধির ক্রিয়া হলে তবেই গড়ে ওঠে জ্ঞানের ইরামত। বিশ্বজগৎ বলতে আমরা এই ইরামতকেই বুঝি। তাহলে, আমরা যা-কিছু জানি তার অনেকখানেই আমাদের মনের সৃষ্টি—জ্ঞাতার বুদ্ধির দান বাদ দিলে বিশ্বপ্রকৃতির রূপ কি রকম হত তা জানবার কোনো উপায়ই আমাদের নেই। যে জগৎকে আমরা জানি তা প্রধাণতই বুদ্ধিনির্মিত। সে জগৎকে পেরিয়ে বস্তুর আসল রূপ আবিষ্কার করবার উপায় না থাকলেও দার্শনিকদের মধ্যে তার আগ্রহ অপরিসীম, এবং এই অপরিসীম আগ্রহের বশবর্তী হয়ে বস্তুসত্তা সম্বন্ধে তাঁরা নানা রকম এলোমেলো মতবাদ প্রচার করেন মাত্র। সে যাই হোক বিশ্বপ্রকৃতিকে বুদ্ধিনির্মাণ বলাই যখন বিজ্ঞানবাদের মূল কথা, তখন কাণ্টকেও নিশ্চয়ই বিজ্ঞানবাদী বলতে হবে।
কাণ্টোত্তর দার্শনিকদের প্রধান উদ্দেশ্য হল কাণ্টের বিজ্ঞানবাদকে আরও একটু মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা। কাণ্টের দর্শনে দ্বৈতবাদের অসহ্য প্রতিপত্তি : একদিকে মানবমন এবং অপরদিক চিরঅজ্ঞাত বস্তুসত্তা। এ দুয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা দূরের কথা, মুখ-দেখাদেখি পর্য্যন্ত নেই! ফিক্টে, শেলিং আর হেগেল এই দ্বৈতবাদের হাত থেকে মুক্তি খুঁজলেন, বিজ্ঞানবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন অদ্বৈতবাদের মজবুত ভিত্তির উপর। ফিক্টে বললেন, কাণ্টের তথাকথিত অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বস্তুস্বরূপ অলীক ধারণা মাত্র। যাকে জানা যায় না, জানবার কোনো উপায়ই নেই, তাকে মানাই বা যাবে কেমন করে? তাহলে, মানুষের মন আর সেই মনের নির্মাণ—এ ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। কিন্তু, মন যে নির্মাণ করে সে নির্মাণের মালমসলা জোটে কোথা থেকে? ফিক্টে বললেন, তথাকথিত কোনো বস্তুস্বরূপ থেকে নিশ্চয় নয়, কেননা সে জিনিস অলীক। তাহলে? মানতেই হবে যে, মানবমন নিজেই জ্ঞানের মালমশলা তৈরি করে, আর তার পর তাকে জানে। এ যেন তার একরকমের লীলা—মন নিজেই নিজের চারপাশে গণ্ডি টানছে!
শেলিং কিন্তু ফিক্টের কথায় সায় দিতে পারলেন না : আমাদের মন, আমাদের সংকীর্ণ ব্যক্তিগত মন, একমাত্র সত্য হতে পারে না। পরমসত্তা হলো ব্রহ্ম-মন, এবং এ ব্রহ্মের এমন বর্ণনা তিনি দিলেন যে শেষ পর্যন্ত যেন তিনি স্পিনোজার ব্রহ্মবাদেই ফিরে যেতে চান। তারপর হেগেল। ফিক্টের মতো আমাদের ব্যক্তিগত মন বা চিন্তাধারাকেই একমাত্র সত্য বলে মেনে নিতে তিনি রাজি নন, অপরপক্ষে স্পিনোজা বা শেলিং-এর সঙ্গে নির্গুণ ব্রহ্মের ব্যাখ্যাতেও তাঁর উৎসাহ নেই। অথচ, কাণ্টীয় অজ্ঞানবাদ একেবারেই অসহ্য। ফলে, হেগেল সুরু করলেন সগুন ব্রহ্মের কথা। পরমসত্তা ব্রহ্ম-মন সন্দেহ নেই; কিন্তু এ ব্রহ্মের মধ্যে চিদচিদ্ জগতের স্থান অবিসংবাদিত। বস্তুত, এই চিদচিদ্ জগতের মধ্যে দিয়েই তাঁর বিকাশ। নিজের চারপাশে স্বেচ্ছা-গণ্ডী রচনা করা তাঁর লীলা নয়—তাঁর লীলা হল সীমার মধ্যে অসীম সত্তাকে প্রকাশ করা। হেগেলের দার্শনিক প্রতিভার সঙ্গে মিলেছিল তাঁর পাণ্ডিত্য, এবং এই পাণ্ডিত্যের বলে জ্ঞানের প্রত্যেক অঙ্গ বিচার করে তিনি দেখলেন কেমন করে পরব্রহ্ম ইতিহাসের প্রত্যেকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছেন। হেগেলের ব্রহ্মবাদ তাই সর্বগ্রাসী ব্রহ্মবাদ।