কিন্তু মজার কথা এই যে, বিজ্ঞানের প্রকৃত পদ্ধতি নিয়ে এঁদের মধ্যে যত কলহই থাকুক-না কেন, বিশ্বের স্বরূপ বর্ণনায় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্চর্য মিল। কেননা, এ যুগের দার্শনিকদের মধ্যে যে-মত সত্যিই প্রাধান্য পেয়েছে তা হল বিজ্ঞানবাদ,—যদিও এ বিজ্ঞানবাদ সর্বত্র সমান স্পষ্ট নয়, কোথাও বা তা ব্যক্ত কোথাও বা প্রচ্ছন্ন। বিজ্ঞানের মূল কথা—বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব সত্তা বলতে কোনো কিছু নেই, তার অস্তিত্ব আসলে নির্ভর করে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার উপর। একদিকে বিজ্ঞান সম্বন্ধে অমন অগাধ উৎসাহ এবং অপর দিকে বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব সত্তা অস্বীকার করাটা মজার ব্যাপার নয় কি? কারণ, অন্তত সহজবুদ্ধিতে যা মনে হয়, বিশ্বপ্রকৃতির প্রকৃত সত্তা সম্বন্ধে সন্দিহান হলে বৈজ্ঞানিকের পক্ষে জ্ঞান, গবেষণা বা আবিষ্কারে উৎসাহী হওয়া সম্ভবই নয়। তবুও বিজ্ঞানের দোহাই দিয়েই, বিজ্ঞানের স্বরূপ সম্বন্ধে মনগড়া মতবাদ প্রচার করে, এ যুগের দার্শনিকদল একটানা এগিয়ে চললেন বিজ্ঞানবাদের দিকেই! এবং যাঁরা এই বিজ্ঞানবাদে সায় দেয়নি, যাঁরা জড়বাদের জয়ধ্বনি তুলতে চেয়েছিলেন (যেমন বিশেষ করে ফরাসী জড়বাদীদের কথা বলা যায়) পেশাদার দার্শনিক মহলে তাঁদের যেন আমলই দেওয়া হল না। অবশ্যই সমাজতত্ত্বের পণ্ডিত মনে করিয়ে দেন যে, এ যুগের দর্শনে এমনটা না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ, য়ুরোপের নতুন সমাজে—ধনতান্ত্রিক সমাজে—শ্রেণীবিভাগ অত্যন্ত প্রকট হয়ে পড়ল। একদিকে দিন মজুরের দল—তারা শুধুই গতর খাটায় এবং শুধু গতর খাটায় বলেই মাথা খাটাবার ফুরসত পায় না। অপরদিকে বিজয়ী মধ্যবিত্তর দল। তাদের হাতে পুঁজি জমল অজস্র এবং তারা দেখল পুঁজি খাটিয়েই পুরুষার্থ লাভ হয়, গতর খাটাবার প্রয়োজন নেই, মাথা খাটাবার ঢালাও অবসর। নবযুগের দার্শনিকদল এই নব্য শ্রেণীরই প্রতিনিধি—চিন্তার আর জ্ঞানের জয়ধ্বনি না তুলে তারা পারবে কেন? বিজয়োন্মত্ত নব্য মধ্যবিত্তশ্রেণী কারো কোনোরকম দাসত্ব মানতে রাজি নয়—এমনকি জ্ঞানের বেলাতেও বিষয়ের হুকুম, বিষয়ের দাসত্ব স্বীকার করা অসম্ভব। তাছাড়া, এই চিন্তা বা জ্ঞান জিনিসটার মধ্যেই যে তার তার একান্ত নিজস্ব স্বাক্ষর। তাই দার্শনিকের দলও প্রচার করলেন সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি জ্ঞাতার মনের মুখাপেক্ষী। এর কোনো নিজস্ব সত্তাই নেই—জ্ঞাতার উপর হুকুম জারি করা তো দূরের কথা। এদিকে বিজ্ঞানের কথাটাও অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়; কেননা বিজ্ঞানকে অস্ত্র হিসেবে পেয়েছিল বলেই নব্য মধ্যবিত্তশ্রেণীর জয়জাত্রা সম্পূর্ণ হতে পেরেছিল। আর, বিজ্ঞানকে মেনে নিয়ে, এমন কি বিজ্ঞান সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হয়েও, বিজ্ঞানবাদ মানতে বাধা নেই। সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতিকে মনগড়া জিনিস বলে প্রচার করবার সাহস ও তর্কবল যাদের আছে তাদের পক্ষে বিজ্ঞানের একটা মনগড়া ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়।
অবশ্য আগেই বলেছি, এ যুগের সমস্ত দার্শনিকদের বিজ্ঞানবাদ সর্বত্র সমান স্পষ্ট নয়। কাণ্টের পর থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে, কিন্তু কাণ্টের আগে পর্যন্ত বুদ্ধিবাদী এবং ইন্দ্রিয়বাদী দুই দার্শনিক সম্প্রদায় কেমন ভাবে স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন বিজ্ঞানবাদী তা আলোচনা করতে হবে। বুদ্ধিবাদ দিয়ে শুরু করা যাক।
ডেকার্ট দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন চরম নিশ্চয়তার উপর। এ নিশ্চয়তা কোথায় পাওয়া যাবে? বিশ্বের বস্তুরাজ্যে নয়, কেননা স্বপ্নে তার সত্তা অবিকৃত থাকে না। এমন কি গণিতের রাজ্যেও নয়, কেননা গণিতে বুদ্ধির বিশুদ্ধ ক্রিয়া হলেও এমন তো হতেই পারে যে এক দুষ্ট স্রষ্টার কূট ইচ্ছায় আমাদের বুদ্ধি-ব্যাপারটার মূলেই গলদ রয়ে গিয়েছে। তাহলে? সংশয়ের সীমা সম্পূর্ণ পেরিয়ে কি কিছু খুঁজে পাওয়া যায়? উত্তরে ডেকার্ট বললেন, একমাত্র আমাদের মন, আমাদের চিন্তাশক্তি, সবরকম সংশয়ের সীমা পেরিয়ে রয়েছে। কেননা, সংশয় ব্যাপারটাই চিন্তার ক্রিয়া এবং স্রষ্টা যদিই বা প্রতি পদে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিভ্রান্ত করতেই উৎসুক হন তাহলেও অন্ততঃ বিভ্রান্ত হবার জন্যেও এই বুদ্ধিবৃত্তির সত্তা অবশ্যম্ভাবী। তাই, দুনিয়ার সব কিহচু সম্বন্ধে সংশয় করা যেতে পারে, পারে না শুধু জ্ঞাতার অস্তিস্ত্ব সম্বন্ধে। কাণ্ট তাই ডেকার্ট-দর্শন সংশয়াত্মক বিজ্ঞানবাদ বলে বর্ণনা করেছেন। স্পিনোজা এলেন ডেকার্টের পর; বললেন—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। এই ব্রহ্মের, এই অবিকারী সনাতন সত্তার স্বরূপ কি? উত্তর পাওয়া যায় স্পিনোজার গ্রন্থের শেষাংশে—ব্রহ্মজ্ঞান, যার নাম তিনি দিয়েছেন প্রেমগত জ্ঞান, তার মধ্যেই ব্রহ্মের বিকাশ; বেদান্তে যেমন বলা হয়—সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তম। এই মতবাদকে বিজ্ঞানবাদ বলে স্বীকার না করে আর উপায় কি? স্পিনোজার পর লাইবনিৎস্। লাইবনিৎসের বিজ্ঞানবাদ স্পষ্ট ও ব্যক্ত। জ্ঞাতার প্রত্যক্ষ তাঁর কাছে প্রত্যক্ষাভাস মাত্র, কেননা জগৎ আর কিছুই নয়, অসংখ্য চিৎপরামাণুর লীলা। যাকে আজ জড় বলে মনে হচ্ছে আসলে তা হল অচেতন মন—ক্রমোন্নতির পথে একদিন তার মধ্যেও চেতনার সাড়া পাওয়া যাবে।
এই তো গেল বুদ্ধিবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের কথা। অপরপক্ষে ইন্দ্রিয়বাদও ক্রমশঃ একটানা গিয়ে চলল বিজ্ঞানবাদের পথে। লক্ অবশ্যই সচেতনভাবে বিজ্ঞানবাদী ছিলেন না। কিন্তু লকের দার্শনিক বংশধর বার্কলি ও হিউম স্পষ্টই দেখতে পেলেন দর্শনে লক যে বীজ বপন করেছেন তার একমাত্র ফল হল বিজ্ঞানবাদ। অর্থাৎ, লকের মূলসূত্র যদি মানতেই হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানবাদ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। লকের প্রধান কথা ইন্দ্রিয়-সংবেদনই জ্ঞানের একমাত্র উৎস, এবং এ বেদনা যার সংবাদ দেয় শুধু তার সত্তাই অবিসংবাদিত। অথচ, নিছক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্জগৎ বলে কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভবই নয়। ইন্দ্রিয় মানবমনের কাছে যে সংবাদ আনে তা শুধু কয়েকটি ইন্দ্রিয়-সংবেদনেরই এবং সেই বেদনাগুলি মানসিক জিনিস, বহির্জগতের জিনিস মোটেই নয়। পাঠ্যপুস্তকের অতি প্রচলিত উদাহরণটাই ধরা যাক : নিছক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে টেবিল বলে কোনো জিনিসের সন্ধান কি মানুষ কখনো পেয়েছে? যা পাওয়া যায় তা তো শুধু কয়েকটি ধারণা—চোখ দিয়ে রঙের আর আকৃতির ধারণা, হয়তো বাদামী রঙের ধারণা, চৌকো আকৃতির ধারণা; স্পর্শ দিয়ে কাঠিন্যের ধারণা, মসৃণতার ধারণা—এই রকম শুধু কয়েকটি ধারণাই। এবং ধারণা মাত্রই মানসিক। হয়তো অভ্যাস বশতঃ এই সব ধারণার সমষ্টিকেই আমরা টেবিল বলে উল্লেখ করি; কিন্তু এই বস্তু-টেবিল-কে কোনোদিন চোখেও দেখি নি, হাত দিয়েও স্পর্শ করি নি। অতএব, নিছক ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করতে হলে টেবিল বলে বস্তুর কথাই তোলা উচিত নয়—অজস্র মানসিক ধারণা এবং তাদের সমষ্টি ছাড়া দুনিয়ার আর কিছুই নেই। এ হল চরম বিজ্ঞানবাদের কথা, এবং হিউম পরিষ্কার ভাবে প্রমাণ করে দিলেন যে ইন্দ্রিয়বাদের এই হল একমাত্র পরিণতি।