- বইয়ের নামঃ আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শন
- লেখকের নামঃদেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃদর্শন
১. পটভূমি (আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শন)
অরুন্ধতী নক্ষত্রকে আকাশের অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া কঠিন; তার যে-জ্যোতি পৃথিবীতে এসে পৌঁছোয় সে-জ্যোতি বড় সূক্ষ্ম, বড় ক্ষীণ। অথচ, আমাদের দেশে প্রথ ছিল বিবাহরাত্রে নববধুকে সেই নক্ষত্র দেখানো। এই দুরূহ কাজ সহজে সেরে নেবার জন্যে প্রাচীনেরা এক উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। অরুন্ধতীর কাছাকাছি আকাশে যে উজ্জ্বলতর নক্ষত্র চোখে পড়ে তার দিকে নববধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রথমে বলা হত : ওই দেখ অরুন্ধতীর উপর নিয়ে যাওয়া কঠিন হত না। লোকব্যবহারের এই উপমা দিয়ে প্রাচীনেরা দর্শনশাস্ত্রেও একটি পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন, সে-পদ্ধতির নাম তাই অরুন্ধতী-ন্যায়। বক্তব্য যেখানে বেশি জটিল, বেশি সূক্ষ্ণ, সেখানে প্রথমেই পাঠককে তার মধ্যে টেনে আনতে গেলে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা—অপেক্ষাকৃত স্থূল কথা দিয়ে আলোচনা সুরু করে ক্রমশ সূক্ষ্মের দিকে অগ্রসর হওয়াই শ্রেয়।
বিশ্ববিদ্যা-সংগ্রহের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শন সম্বন্ধে সাধারণ-পাঠ্য, অতএব সহজবোধ্য, পুস্তিকা রচনায় প্রয়াসী হয়ে প্রাচীনদের উক্ত পদ্ধতিতে অমূল্য উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করেছি। হালের বিদেশী দর্শনে কূটতর্ক ও অতি সূক্ষ্ম প্রসঙ্গের এমন প্রাচুর্য যে সে-সবের অক্ষম উল্লেখ করেও সাধারণ পাঠককে বিপর্যস্ত করে ফেলা যায়। তাতে নিশ্চয়ই মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। অপরপক্ষে, এ-যুগের দর্শনকে নিছক বহিঃরেখার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করা উচিত। কেবল বলে রাখা দরকার—এ নেহাতই স্থূল, বাহ্য পরিচয়—আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শনের প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে এর পর যোগ্যতর ব্যক্তির নির্দেশ মেনে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে।
আপাতত, নেহাত স্থূল পরিচয়ের উদ্দেশী বলেই ‘আধুনিক’ বা ‘দর্শন’ কথার শব্দার্থ নিয়ে তর্ক সংগত হলেও উপেক্ষা করা প্রয়োজন। উভয় শব্দকেই প্রচলিত অর্থে গ্রহণ করা ভালো। এক কথায়, আজকাল বিলেতে পাঁচজনে যে-সব মতবাদকে দার্শনিক মতবাদ বলে স্বীকার করে নেন তারই সামান্য পরিচয় এ পুস্তিকার একমাত্র আদর্শ।
হালের য়ুরোপীয় দর্শনের একদিকে ব্রাডলি প্রমুখের পরব্রহ্মবাদ, এবং অপরদিকে নানা ভাবে, নানান দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সর্বগ্রাসী ব্রহ্মবাদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ, তীব্র বিদ্রোহ। কিন্তু আলোচনা সুরু করতে হবে আরও গোড়ার কথা থেকে। কেননা, সাম্প্রতিক ব্রহ্মবাদে হেগেল-দর্শনের প্রতিধ্বনি; এবং মধ্যযুগের পর থেকে য়ুরোপীয় দর্শনে যে আন্দোলন সুরু হয়েছিল তারই চরম বিকাশ দেখা গেল হেগেলে। তাই, পটভূমি হিসেবে, সে-যুগের কথাটুকু বলে নেওয়া দরকার।
মধ্যযুগের দার্শনিকদল প্রধাণত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। বিশ্বের চরম রহস্য যে ধর্মপুঁথির পাতায় আবদ্ধ এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা ছিল নেহাতই নাস্তিক নির্বুদ্ধিতা; দর্শনের আসল কাজ তাই তথ্য আহরণ নয়, অর্থ বিশ্লেষণ—ধর্মের গূঢ় রহস্য মানববুদ্ধির আওতায় এনে দেওয়া। এ-যুগের দর্শন তাই বন্ধ্যা আধ্যাত্মিকতা এবং শব্দার্থ প্রভৃতি নিয়ে কূট বিচারের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। তখন কোনো মহৎ চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্ম যে হয়নি তা নয়, কিন্তু তাঁরাও ছিলেন যুগের দাস। সমাজতত্ত্বের পণ্ডিত তাই বলেন দর্শনের এ দুর্গতি সামাজিক দুর্গতিরই প্রতিধ্বনি। মধ্যযুগে সমাজের দেহে প্রাণশক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল এবং সেন্ট্ টমাস এ্যাকুরিনাসের মত প্রখর মেধাবীকেও এই অথর্ব সমাজেরই দাসত্ব মানতে হয়েছিল।
তারপর য়ুরোপে ধন উৎপাদন এবং বণ্টন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দেখা দিল আর এই আলোড়নের ঢেউ এসে লাগল শিল্প ও সংস্কৃতির তথাকথিত নৈর্ব্যক্তিক রাজত্বেও। দার্শনিকের দল নতুন উৎসাহে কাজ সুরু করলেন, মধ্যযুগের বৃথা তর্কে তাঁদের আর মন উঠল না। অধ্যাত্মবিদ্যার ঘোলাজলে কুপমণ্ডূকের মত বসে থাকা নয়—নতুন পথে এগোতে হবে। কিন্তু কোন্ পথ? তখন তাঁদের সামনে পথ শুধু একটাই : যে পথে বিজ্ঞান এগোয়। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অভিযান সকলের চোখে নেশা ধরিয়েছে, বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার দুনিয়ার চেহারা একেবারে বদলে দিতে চাইছে। অবশ্যই, এ পথ দুর্গম,—পুরোনো পৃথিবীর যারা প্রতিনিধি তারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে, মরিয়ার মত যে-কোনো উপায় অবলম্বন করে এই অগ্রগতি রুখতে বদ্ধপরিকর। তবু, অনেক সংগ্রামের পর, অনেক আত্মোৎসর্গের পর—রোজার বেকন, লিওনার্দ্য দা ভিঞ্চি, কোপার্নিকাস্, গ্যালিলিও, কেপনার, ব্রুণো প্রভৃতির বিরাট ব্যক্তিত্বের সাহায্যে,—শেষ পর্য্যন্ত বিজ্ঞানেরই জয় হল এবং দার্শনিকের দল প্রায় অবিসংবাদিক ভাবেই স্বীকার করলেন বিজ্ঞানের পদ্ধতি আর দর্শনের পদ্ধতি অভিন্ন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষাশেষি দার্শনিক মহলে শোনা গেল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উচ্ছ্বসিত আগমনী। উদাহরণ, ইংলণ্ডে ফ্রান্সিস্ বেকন আর ফ্রান্সে রেনে ডেকার্ট। কিন্তু বিপদ বাধল বিজ্ঞানের প্রকৃত রূপ নির্ণয় নিয়ে। এই সমস্যার মুখোমুখি এসে দার্শনিকদল স্পষ্ট দুভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। ডেকার্ট, স্পিনোজা আর লাইবনিৎস্ ঠিক করলেন বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ গণিতশাস্ত্রে এবং গণিতশাস্ত্রের সাফল্যের মূল রহস্য শুদ্ধবুদ্ধি-নির্ভরতা। অতএব, বিশুচ্ছ বুদ্ধিই দার্শনিকের অস্ত্র হওয়া উচিত। অপরপক্ষে, বেকনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে লফ্, বার্কলি এবং হিউম প্রচার করলেন যে পদার্থবিজ্ঞানই প্রকৃত বিজ্ঞান এবং এখানে জ্ঞান যে বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে তার একমাত্র কারণ অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয়সংবেদ-এর উপর একান্ত নির্ভরতা।