নাসরিন দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এসে বলল, খালুজান সুপারি। খাইবেন? সুপারি দেই? পান-সুপারি। আইন্যা রাখছি।
মিসির আলি বললেন, পান-সুপারি তো আমি খাই না মা। আচ্ছা ঠিক আছে এনেছ যখন দাও।
নাসরিন পান-সুপারি এনে দিল। মিসির আলি বললেন, আমাকে খালুজান ডাকা তোমার ঠিক না। খালার স্বামী হল খালু। আমি বিয়ে করি নি।
নাসরিন বলল, আমি আপনেরে খালুজানই ডাকব।
মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে। ডেকা। তুমি কি লিখতে-পড়তে জান?
নাসরিন না-সূচক মাথা নাড়ুল।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাব! তোমার বুদ্ধি আছে, তুমি অতি দ্রুত লেখাপড়া শিখতে পারবে। এখন যাও গো মা শুয়ে পড়। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি পড়তে পারি না।
নাসরিন সরে গেল। কিন্তু ঘুমাতে গেল না। সাবধানে মোড়া টেনে দরজার পাশে বসল। এখান থেকে বুড়ো মানুষটাকে দেখা যায়। এই তো উনি পড়া শুরু করেছেন–
মিসির আলি খাতার পাতা উন্টালেন। শুরুতেই লেখা–
(দ্বিতীয় অধ্যায়)
দ্বিতীয় অধ্যায় বাক্যটা শুধু বাংলায়। বাকিটা আগের মতোই ইংরেজিতে।
যে, ইবলিশ শয়তান নিয়ে বাবার এত সাবধানত সেই ইবলিশ শয়তানকে আমি একদিন দেখলাম। লম্বা কালো ভয়ংকর রোগ। তার গায়ে নীল রঙের শার্ট। দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগলে যেমন হয় তেমন চেহারা। চোখ পশুদের চোখের মতো জ্বলজ্বলে।
ঘটনাটা বলি।
বাড়িতে শুধু আমরা দুই বোন। বাবা বাড়িতে নেই। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি বাড়িতে থাকেন না। তিনি তাঁর পীর সাহেবের কাছে যান। পীর সাহেব তাকে নিয়ে সারা রাত জিগির করেন।
আমরা খালি বাড়িতে যেন ভয় না পাই সেজন্য বাবার কলেজের একজন পিয়ন আমাদের সঙ্গে থাকে। পিয়নের নাম ইসমাইল। ইসমাইলের রাতকানা রোগ আছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে সে বাড়িতে আসে। এসেই বসার ঘরের সোফায় চাদর গায়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে। পরদিন সকালে। রাতের খাবারের জন্য একবার তার ঘুম ভাঙানো হয়।
আমার লেখা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আগেরটা পরে পরেরটা আগে লিখে ফেলছি। ইবলিশ শয়তানকে আমার আগে দেখেছে ইথেন। তার গল্পটা আপে বলা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা পরে বলছি। এক বৃহস্পতিবার রাতে ইথেন চিরুনি হাতে আমার সামনে বসতে-বসতে বলল, আপা তোর সাহস কেমন?
আমি বললাম, সাহস ভালো।
ইথেন বলল, তোর ভালো সাহসী হওয়া দরকার। সাহস কম হলে তুই বিপদে পড়বি। প্রতি বৃহস্পতিবার বাবা চলে যাবে জিগির করতে। তুই থাকবি একা।
আমি বললাম, একা থাকব। কেন? তুই তো আছিস।
ইথেন বলল, আমি তো থাকব না। আমি মারা যাব। পেটের বাচ্চা খালাস করতে গিয়ে মারা যাব। কিংবা তারও আগে ইবলিশ শয়তান আমাকে মেরে ফেলবে।
আমি বললাম, উদ্ভট কথা আমাকে বলবি না।
ইথেন বলল, আমি কোনো উদ্ভট কথা বলছি না। ইবলিশ শয়তান যে এ বাড়িতে বাস করে এটা আমি জানি। আমি দেখেছি।
কোথায় দেখেছিস?
একবার দেখেছি। ছাদে, আরেকবার দেখেছি রান্নাঘরে। সে চেহারা বদলায়। ছাদে যাকে দেখেছি আর রান্নাঘরে যাকে দেখেছি তারা দেখতে দুরকম। একজন ছিল কুচকুচে কালো আরেকজন ধবল। কুষ্ঠ রোগীর মতো সাদা।
আমি বললাম, ইথেন তুই আমাকে ভয় দেখাবি না। ইথেন বলল, ভয় দেখাচ্ছি না। যেটা ঘটেছে সেটা বলছি। পুরোপুরি বলছি। দাঁড়ি-সেমিকোলনসহ।
দরকার নেই।
দরকার আছে। আগে থেকে জানলে সাবধান থাকতে পারবি। নয়তো হঠাৎ দেখে ভয়ে ভবদা মেরে যাবি। আগে ছাদে কী দেখেছি বলি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলার কথা। সালোয়ার-কামিজ পরেছি। ওড়না খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে হল আমি ওড়না ছাদে শুকাতে দিয়েছি। শুধু ওড়না না তার সঙ্গে দুটা ব্লাউজ ছিল। পেটিকেট ছিল। আমি ছাদে গেলাম। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ঘরের দরজা সব সময় খোলা থাকে সেদিন দেখলাম বন্ধ। দরজায় কোনো তালা নেই। ধাক্কা দিলে খোলার কথা। ধাক্কা দিয়েও খুলতে পারছি না!
আমি ইথেনকে বললাম, সেদিন আমি কোথায় ছিলাম?
ইথেন বলল, তুই তোর ঘরে। তোর জ্বর এসেছিল। তুই চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিলি। মনে পড়েছে?
না মনে পড়ছে না।
ইথেন বলল, দাঁড়া মনে করিয়ে দিচ্ছি। তোর গায়ে অনেক জ্বর তারপরেও বাবা তোকে ফেলে রেখে জিগির করতে চলে গেল। তুই মন খারাপ করলি, এখন মনে পড়ছে?
হুঁ, মনে পড়েছে।
ইথেন বলল, গল্পের মাঝখানে কথা বলবি না। ফ্লো নষ্ট হয়ে যায়। পুরো গল্পটা একবার বলে নেই তারপর যা প্রশ্ন করার করবি। নো ইন্টারাপশান। আমি যেন কোথায় ছিলাম?
সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলতে পারছিলি না।
হ্যাঁ সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলতে পারছি না। ধাক্কাধাব্ধি করছি। একসময় মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ফিরে আসার জন্য রওনা হয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে দু স্ট্রেপ নেমেছি তখন আপনাআপনি দরজা খুলে গেল। ঘটনাটা যে অস্বাভাবিক এটা আমার মনে হল না। আমি খুশি মনে ছাদে গেলাম। ছাদের মাঝামাঝি জায়গায় ইবলিশ শয়তানটা দাঁড়িয়ে ছিল। মিশমিশে কালো। দেখতে মোটামুটি মানুষের মতো। শুধু তার গলাটা অস্বাভাবিক লম্বা। তবে শুরুতেই তার গলার দিকে চোখ গেল না। শুরুতেই যা দেখে কলিজা নড়ে গেল তা হচ্ছে জিনিসটা নগ্ন। তারপর চোখ পড়ল তার গলার দিকে। লম্বা গলার কারণে মাথাটা শরীর থেকে অনেকখানি ঝুঁকে আছে।
নগ্ন মানুষের মতো দেখতে জন্তুটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আমি আতঙ্কে জমে গেলাম। আমার চিৎকার দেওয়া উচিত। ছাদ থেকে ছুটে নেমে যাওয়া উচিত এইসব কিছুই মনে এল না। আমি তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি।