মিসির আলি হেসে ফেললেন। সায়রা বলল, না, আপনি হাসবেন না। আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আমি আপনার কাছ থেকে জবাবটা চাচ্ছি।
কেন চাচ্ছ?
আপনি যে-পদ্ধতিতে রহস্যের সমাধান করেন। সেই পদ্ধতিটা জানতে চাই। শিখতে চাই।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, সায়রা শোন, আমি যা করি তা হল লজিকে ক্ৰটি আছে কি না সেটা প্ৰথমে দেখি। যখন ত্রুটি ধরা পড়ে তখন ত্রুটিটা কেন হল সেটা নিয়ে ভাবি। তারপর লক্ষ করি আচরণগত ত্রুটি।
সেটা কী?
যেমন ধর কোনো একজন মানুষ খুব হাসিখুশি। হঠাৎ-হঠাৎ তার সেই হাসিখুশি
ভাবটা নষ্ট হয়। এটাই তার আচরণগত ত্রুটি।
আপনি আর কী দেখেন?
আর দেখি যে কথা বলে সে কতটা সত্য কথা বলে। মানুষ আল আমিন না। একমাত্র আমাদের প্রফেট আল আমিন হতে পেরেছেন, আমরা বাকি সবাই মিথ্যা বলি। এই মিথ্যাও আবার দু রকম।
দুই রকম মিথ্যা মানে?
একটা মিথ্যা হল সরাসরি মিথ্যা। আরেক ধরনের মিথ্যা আছে যে-মিথ্যাকে মিথ্যা। दलों २३ माँ!
মানে কী?
মানে হচ্ছে, মনে কর তুমি একটা মিথ্যা কথা বলছি, তুমি ভেবে নিচ্ছ এটা সত্যি। এই ধরনের মিথ্যা মানুষ বলে কম, লেখে বেশি।
আপনি আমার লেখা কতটুকু পড়েছেন?
এক চ্যাপ্টার।
পড়তে কেমন লাগছে?
ভালো।
বেশ ভালো না মোটামুটি ভালো?
কেশ ভালো।
বেশ ভালো যদি হয় তা হলে এক চ্যাপ্টার পড়েই পড়া থামিয়ে দিয়েছেন কেন?
আমার কিছু খটকা আছে। খটকা দূর হবার পর দ্বিতীয় চ্যাপ্টার পড়ব বলে ঠিক করেছি।
বলুন কী খটকা?
তুমি লিখেছ HBo-তে সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস দেখেছি। যখনকার কথা বলছি তখন এই ছবি তৈরি হয় নি। তুমি তোমার লেখায় মিথ্যা ঢুকিয়েছ। একটা মিথ্যা যখন ঢুকিয়েছ তখন ধরে নিতে হবে আরো মিথ্যা ঢুকিয়েছ। আমার কাছে এই লেখা উপন্যাস হিসেবে ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ব্যক্তিগত লেখা যা পড়ে আমি তোমার সমস্যা ধরতে পারব এবং সমস্যার সমাধান করব সেই লেখা এটা না।
আপনি ভুল ধরলে আমি ঠিক করে দেব।
সব ভুল তো ধরতে পারব না।
ভুল কিন্তু নেই। সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস-এর ব্যাপারটা বলি-সেই রাতে আমরা একটা ভূতের ছবি দেখি। ছবিটা যথেষ্ট ভয়ের ছিল, আমরা দুই বোনই খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি যখন লেখা শুরু করি তখন আর ভূতের ছবির নাম মনে করতে পারছিলাম না। সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস ছবিটা তার কয়েকদিন আগেই দেখেছি সেই নামটা দিয়ে দিয়েছি। এতে কি বড় কোনো সমস্যা হয়েছে?
আমার জন্য সমস্যা। ছোটখাটো বিষয়গুলো আমার জন্য খুব জরুরি। ভালো কথা, তুমি কি প্রায়ই ভূতের ছবি দেখ?
হ্যাঁ।
দুই বোনই ভূতের ছবি দেখতে পছন্দ কর?
হ্যাঁ!
তোমার বাবা যখন বললেন ইবলিশ শয়তান তার সঙ্গে কথা বলেছে সেটা বিশ্বাস করেছ?
হ্যাঁ, কারণ বাবা কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। আর কিছু জানতে চান?
তোমার বাবা কি বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ বেঁচে আছেন।
আগের মতোই ধৰ্মকৰ্ম নিয়ে আছেন?
হ্যাঁ।
উনি তোমার সঙ্গে থাকেন, তাই না?
হ্যাঁ, উনি আমার সঙ্গে থাকেন। এই বয়সে বাবা নিশ্চয়ই একা একা থাকবেন না। আপনার কী করে ধারণা হল উনি আমার সঙ্গে থাকেন?
আন্দাজে বলছি। তাঁর দুই মেয়ে। একজন মারা গেছে আরেকজন বেঁচে আছে। তিনি জীবিত মেয়ের সঙ্গে বাস করবেন। এটাই তো স্বাভাবিক।
আপনি একটু আগে বলেছেন। আপনি শুধু প্রথম চ্যাপ্টার পড়েছেন। ইথেন যে মারা গেছে এটা আমি শেষের দিকে লিখেছি। তার মানে কিন্তু এই দাঁড়ায় যে আপনি পুরো লেখা পড়েছেন। কিন্তু বলছেন প্রথম চ্যাপ্টার পড়েছেন।
মিসির আলি শান্তগলায় বললেন, আমি প্রথম চ্যাপ্টারই শুধু পড়েছি। প্রথম চ্যান্টার পড়লেই কিন্তু বোঝা যায় যে-বোন সম্পর্কে তুমি লিখছ সেই বোন বেঁচে নেই।
আপনার কথা স্বীকার করে নিলাম। আপনি আর কী জানতে চান?
এই মুহূর্তে আমি আর কিছু জানতে চাচ্ছি না। তবে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
বাবার সঙ্গে আমি আপনাকে দেখা করতে দেব না। কেন দেব না। তাও আপনি জানতে চাইবেন না।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন–ঠিক আছে।
রাত এগারোটা। মিসির আলির সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। খোলা জানালায় হাওয়া আসছে। মিসির আলির গায়ের উপর চাদর। চাদর গলা পর্যন্ত টেনে দিলে আরাম হত, তাতে বই পড়ার অসুবিধা। হাত চলে যাবে চাদরের ভেতর। আজ অবিশ্যি তিনি বই পড়বেন না। সায়রা বানুর লেখা আত্মজীবনীর ২য় অধ্যায় পড়বেন। চোখ ফেভাবে ভারী হয়ে এসেছে বেশি দূর পড়তে পারবেন বলেও মনে হচ্ছে না।
দরজা ধরে নাসরিন মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই তাকে বলেছেন, মাগো, তুমি শুয়ে পড়। বেশিরভাগ সময়ই নাসরিন নামটা তাঁর মনে আসে না। তখন বলেন মাগো। কাজের মেয়েকে মাগো বলা সম্ভবত উচিত না। তিনি কিন্তু আন্তরিকভাবেই বলেন। মিসির আলির ধারণা তার নিজের কোনো মেয়ে থাকলে সে তাকে যতটা যত্ন করুত এই মেয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি যত্ন করে। আজ রাতের খাবারের কথাই ধরা যাক। রাতে রান্না হয়েছে। গরুর মাংস এবং চালের আটার রুটি।
হয়েছে। নাসরিন একটা–একটা করে রুটি সেকে তাঁর পাতে দিয়েছে। এ ধরনের আদরযত্নের কোনো মানে হয় না!
মিসির আলি খাতা খুললেন। আর তখনই নাসরিন বলল, খালুজান আর কিছু লাগব?
মিসির আলি বললেন, মাগো আর কিছু লাগবে না। তুমি শুয়ে পড়।
নাসরিন সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়ালে সরে গেল। এই বুড়ো মানুষটা যতবার তাকে মাগো ডাকে ততবারই নাসরিনের চোখে পানি এসে যায়। সে তার চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না।