ছবি দেখার কথাও কি ইবলিশ শয়তান আপনাকে বলেছে?
হ্যাঁ।
কী ছবি দেখব, সেটা বলেছে? ছবির নাম?
ছবির নাম বলে নাই, শুধু বলেছে ভয়ের ছবি।
আমি বাবার সামনে থেকে উঠে গেলাম, বাবা ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন।
আমরা রাত দুটা পর্যন্ত ছবি দেখলাম। ছবি শেষ করে খেতে গেলাম। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে বাবাকে ডাকতে গোলাম, তিনি যদি মত বদলে খেতে আসেন। বাবার ঘরের দরজা বন্ধ। দরজায় অনেকবার ধাক্কা দেবার পরও তিনি দরজা খুললেন না।
ইথেন কিছু খেতে পারছে না। খাবার নাড়াচাড়া করছে।
আমি বললাম, কী হল, খাবি না?
ইথেন বলল, বমি-বমি আসছে আপা। এখন আমার খাবারের গন্ধ নাকে এলেই বমি আসে।
আমি তাকিয়ে আছি। ইথেন খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। তবে চলে গেল না। চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, আর কিছু বলবি?
ইথেন বলল, হুঁ। ছবি শুরু হবার আগে যে-ঘটনাকে আমি ঠাট্টা বলেছিলাম তা ঠাট্টা না। ঘটনা সত্যি। আমার পেটে বাচ্চা আছে। ফার্মেসি থেকে প্রোগনেসি টেষ্টের কিট এনে প্রোগনেন্সি টেস্ট করিয়েছি। টেস্ট পজিটিভ। সুন্দর রিং হয়।
আমি কিছুই বলছি না, তাকিয়ে আছি। আমার চোখে ভয় না বিস্ময় কী ছিল তা জানি না, তবে ইথেনের চোখে এই প্রথম দেখলাম হতাশা।
ইথেন বলল, আমি জানি তোমরা চাইবে ঐ ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে। সেটা সম্ভব না।
আমি বললাম, সম্ভব না কেন?
কেন সম্ভব না সেটা তোমাকে বলব না। সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না।
এই বলেই ইথেন চলে গেল। হঠাৎ প্রচণ্ড ভয়ে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। আমার কাছে মনে হল ভয়াবহ দুঃসময় আমাদের ওপর চেপে বসতে যাচ্ছে।
(প্ৰথম অধ্যায় সমাপ্ত )
মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। সিগারেট ধরলেন। রান্নাঘরে গেলেন। চুলা ধরিয়ে চায়ের কেটলি বসালেন। রাত বেশি হয় নি। নয়টা দশ। সাড়ে নয়টার দিকে হোটেল থেকে খাবার আসবে। দুই পিস রুটি, ভাজি, কোনোদিন ঘন ডাল! কোনোদিন মুরগির মাংস। তাঁর ঘরে কাজের লোক নেই। হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তিন বেলাই হোটেল থেকে খাবার আসে। খাবার ভালো। বেশ ভালো। মিসির আলির ধারণা হোটেলওয়ালা তাঁর খাবার আলাদা রান্না করে। তার ধারণার পেছনের কারণ হল রাতের খাবারটা হোটেলের মালিক হারুন বেপারী, হটপটে করে নিজে নিয়ে আসে। খাওয়াদাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামনে বসে থাকে। মিসির আলির সঙ্গে সে অতি আগ্রহের সঙ্গে নানান বিষয়ে গল্প করে। গল্পের কোনো বিশেষ ধারা নেই। একেক দিন একেকটা! যেমন গতকাল গল্পের বিষয়বস্তু ছিল—সাপের মণি শক্ত না নরম।
মিসির আলি বললেন, সাপের তো মণিই হয় না, শক্ত নরমের প্রশ্ন উঠছে না।
হারুন বেপারী বিস্মিত হয়ে বলল, মিসির আলি সাব, আপনি অনেক জ্ঞানী লোক। তার পরেও সব জ্ঞানী লোক সব বিষয় জানে না। আপনেও জানেন না। সাপের মণি অবশ্যই হয়-আমি নিজ চোখে দেখেছি। এখন বলেন আমি মিথ্যা দেখেছি।
মানুষের দেখার মধ্যেই ভুল থাকে। দড়ি দেখেও অনেকে মনে করে সাপ। এজন্যই বলা হয়। রজুতে সৰ্প ভ্রম।
হারুন বলল, যারা মালটাল খেয়ে হাঁটাইটি করে তারা দড়ি দেখে বলে সাপ। আমি জিন্দেগিতে মাল খাই নাই। কোনোদিন খাবও না ইনশাল্লাহ্। যদি কোনোদিন এক ফোটা মাল খাই আপনার কাছে এসে স্বীকার যাব। আপনি আমাকে পায়ের জুতা দিয়ে দুই গালে দুই বাড়ি দিবেন।
এই ধরনের মানুষের সঙ্গে কোনোরকম তর্কে যাওয়াই বিপজ্জনক। মিসির আলি তর্কে পারতপক্ষে যান না। লোকটি তাকে পছন্দ করে। মাত্রার বেশিই পছন্দ করে। সেই পছন্দকে তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না।
হারুন বেপারী গত সপ্তাহে তাঁকে একটা মোবাইল টেলিফোন গিফট করেছে। বাজার থেকে কিনে এনে যে গিফট করেছে তা না। কোনো এক কষ্টমার নাকি মোবাইল টেলিফোন তার দোকানে ফেলে গেছে। সে মোবাইল টেলিফোনের সিম কার্ড ফেলে নতুন সিম কার্ড ভরে উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছে মিসির আলির জন্য।
মিসির আলি বলেছেন, ঐ কাষ্টমার নিশ্চয়ই মোবাইল টেলিফোনের খোঁজে আপনার রেস্টুরেন্টে আসবে।
হারুন বলেছে—সকালে ফালায়ে গেছে-দুপুরে আইস উপস্থিত। আমি বলেছি আমরা কিছু পাই নাই।
কাজটা কি ঠিক হল?
অবশ্যই ঠিক হইছে। তুই সাবধানে চলাফিরা করবি না? যেখানে সেখানে জিনিসপত্র ফালায়া চইল্যা যাবি?
মিসির আলি কাতর গলায় বললেন, ভাই আমি এই টেলিফোন রাখব না।
কেন রাখবেন না? আপনি তো চুরি করেন নাই। আমি আপনারে দিতেছি।
আমার টেলিফোনের দরকার নাই।
অবশ্যই দরকার আছে। এখন মোবাইলের জমান। আমি আপনার ছোট ভাই হিসেবে দিতেছি। আপনের রাখতে হবে।
ঝামেলা এড়াবার জন্য মিসির আলি টেলিফোন রেখে দিয়েছেন। তবে কখনো ব্যবহার করেন নি। ব্যবহার করার আসলেই কোনো প্রয়োজন পড়ে নি।
আজ ইচ্ছা করলে ব্যবহার করা যায়। সায়রা নামের মেয়েটিকে কয়েকটা প্রশ্ন করা সরকার।
১. সায়রার বাবা হাবিবুর রহমান সাহেব এখনো জীবিত কি না।
২. তাদের বাড়িতে দুই বোন এবং বাবা ছাড়া অন্য কেউ থাকে কি না।
৩. সায়রা যে লেখা লিখছে হুবহু সত্য কি না। তার লেখার ভঙ্গি উপন্যাসের ভঙ্গি। উপন্যাস-লেখক সত্য ঘটনা বর্ণনার সময়ও নানান রঙ ব্যবহার করেন। নানান রঙের মিশ্রণ থেকে সাদা-কালো সত্য বের করা বেশ কঠিন হয়ে যায়।
ইবলিশ শয়তান মেয়েদের বাবার সঙ্গে গল্পগুজব করছে, বাবাকে বলছে মেয়েরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ভয়ের ছবি দেখবে এটা একেবারেই অসম্ভব। একজন কেউ মিথ্যা বলছে। হয় হাবিবুর রহমান সাহেব বলছেন অথবা সায়রা তার লেখা রহস্যময় করার জন্য বানিয়েছে।