নিজের মেয়ে সম্পর্কে এমন ভয়াবহ কথা শোনার পর পৃথিবীর কোনো বাবা বলতে পারেন না-আতারের শিশিট দেখি।
গায়ে আন্তর মাখা তিনি সম্প্রতি শুরু করেছেন। এক সুফি মানুষ নাকি মেশকে আম্বর নামের এই শিশি দিয়েছেন। আতরের বৈশিষ্ট্য হল গন্ধ অতি কড়া, তবে কড়া গন্ধে মাথা ধরে না।
আমি বললাম, বাবা সত্যি আন্তর এনে দেব?
বাবা বললেন, হুঁ। ইবলিশ শয়তান সুগন্ধি সহ্য করতে পারে না। তার পছন্দ সালফার-পোড়া দুৰ্গন্ধ, সব সময় গায়ে আতর মাখবি।
আমি আতরদানি এনে বাবার সামনে রাখলাম। তিনি অনেক আয়োজন করে আন্তর দিলেন। প্রথমে তুলায় আন্তর মাখলেন। সেই তুলা হাতে ঘষলেন, নাকে ঘষলেন, শেষ পর্যায়ে কানোর ভাঁজে রেখে দিলেন।
আমি বললাম, তুমি কি ইথেন বিষয়ে কিছু বলবে? নাকি আমি চলে যাব? তুমি আরো চিন্তাভাবনা করবে?
বাবা বললেন, আমার মেয়েটির কোনো দোষ নাইরে মা। সব শয়তান করাচ্ছে। তাকে শয়তানের হাত থেকে বাচাতে হবে। প্রথম যে-কাজটা করতে হবে তার কাছে যেন শয়তান যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। তাকে পাক-পবিত্র থাকতে হবে। নাপাক শরীর শয়তানের পছন্দ। তার গায়ে সুগন্ধি থাকতে হবে। সে আতর মাখবে বলে মনে হয় না। তাকে সেন্ট মাখতে হবে। তাকে…
আমি বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, বাবা তুমি মনে হয় মূল বিষয়টা ধরতে পারছ না। ইথেন বলছে–তার পেটে বাচ্চা। এটার কী করবে?
বাবা বললেন, আমার কী করা উচিত?
আমি বললাম, আমি তো বুঝতে পারছি না। বাবা! বিষয়টা আমার জন্য জটিল।
বাবা বললেন, যে-ছেলের কারণে ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে ইথেনের বিবাহ দিয়ে দেব ইনশাল্লাহ। যে-ছেলের কারণে ঘটনা ঘটেছে তার নাম-ঠিকানা এনে দে। আমি তাকে রাজি করব। প্রয়োজনে তার পায়ে ধরব।
আমি বললাম, যে-ছেলে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে সে তো খারাপ ছেলে। তুমি তার সঙ্গে ইথেনের বিয়ে দেবে?
হ্যাঁ দেব। এতে ইথেনের সম্মান রক্ষা হবে। সম্মান অনেক বড় জিনিসরে মা। তুই ছেলেটার নাম-ঠিকানা এনে দে। আর শোন মা, আজ রাতে আমি কিছু খাব না। উপোস দেব। সারা রাত উপোস নিয়ে আল্লাহপাকের নাম জিগির করব।
বাবা মোমবাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিলেন। আমি গোলাম ইথেনের কাছে।
ইথেন খুবই স্বাভাবিক। কিটক্যাট চকোলেটের একটা প্যাকেট তার হাতে। সে খাটে বসে পা দোলাচ্ছে। আমি ঘরে ঢুকতেই সে বলল, আজ রাতে HBo-তে ভালো মুভি আছে আপা, দেখবি? Silence of the Lambs.
আমি বললাম, মুভি দেখব না। তোর সঙ্গে কথা আছে।
মুভি দেখার ফাঁকে-ফাকে কথা বলব। যখন অ্যাড হবে তখন কথা বলব। আপা চকোলেট খাবি?
আমি বললাম, বাবা ছেলেটার নাম-ঠিকানা চাচ্ছে।
কোন ছেলেটার?
যে-ছেলেটার সঙ্গে কাণ্ড ঘটিয়েছিস।
কী কাণ্ড ঘটিয়েছি?
আমার সঙ্গে ফাজলামি করিস না। তুই জানিস তুই কী ঘটিয়েছিস।
ইথেন হেসে ফেলল। হাসাতে-হাসতে সে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে এমন অবস্থা। আমি বললাম, হাসছিস কেন?
ইথেন বলল, তোকে বোকা বানিয়ে খুব মজা পেয়েছি। এই জন্য হাসছি। মন দিয়ে শোন, আমার কিছুই হয় নি। কারো সঙ্গে কিছু ঘটে নি। আমার ভয়ংকর কথা শুনে তুই কী করিস, বাবার কী রিঅ্যাকশান হয় এটা দেখার জন্যই আমি গল্প বানিয়েছি।
গল্প বানিয়েছিস?
হুঁ। ভালো কথা, আমাদের হুজুর তোর কাছে সব শুনে কী করল, মাথা ঘুরে পড়ে গেল?
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। ইথেন বলল, আপা এখন বল, ছবি দেখবি?
হ্যাঁ, দেখতে পারি।
থ্যাংক য়্যু। ভয়ের ছবি একা দেখে মজা নেই। ভয়ের ছবি সব সময় দুজন মিলে দেখতে হয়। হাসির ছবি দেখতে হয় চার-পাঁচ জন মিলে–ভয়ের ছবি শুধু দুই জন। আমি বললাম, তুই যে মিথ্যামিথ্যি ভয় দেখিয়েছিস এটা বাবাকে বলে আসি?
যা বলে আয়। আনন্দসংবাদ শুনে ট্যাবলেট হুজুর কী করে কে জানে। আমি বাবার ঘরে ঢুকলাম। মোমবাতি জ্বালিয়ে বাবার পাশে বসলাম। দেখলাম বাবার মুখ ছাইবৰ্ণ। কপালে ঘাম। তিনি সামান্য কাঁপছেন। তাঁর ঠোঁট নড়ছে। নিশ্চয়ই কোনো দোয়াদরূদ পড়ছেন। তিনি ইশারায় আমাকে চুপ করে থাকতে বললেন। তিনি বড় কোনো দোয়ার মাঝখানে আছেন। দোয়া শেষ না হওয়া পৰ্যন্ত তিনি কারো কথা শুনবেন না।
আমি অপেক্ষা করে আছি। একসময় তার দোয়া শেষ হল। তিনি আমার দিকে ফিরলেন এবং বললেন, মা, ইবলিশের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ইবলিশ আমাকে বলেছে-তোমার মেয়ে বিষয়টা অস্বীকার করবে। ভাব করবে। ঠাট্টা। কিন্তু ঘটনা সত্য।
ইবলিশের সঙ্গে তোমার কখন কথা হয়েছে?
তুমি আমার এখান থেকে যাওয়ার পরেই। ইথেন কি তোমাকে এরকম কিছু বলেছে?
হুঁ।
তার কথা বিশ্বাস করবে না।
আমি বললাম, তার কথা বিশ্বাস করব না, ইবলিশ শয়তানের কথা বিশ্বাস করব?
বাবা বললেন, এই ক্ষেত্রে করবে। শয়তান সব সময় সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশায়। এমনভাবে মিশায় যে সত্য-মিথ্যা আলাদা করা যায় না।
আমি বললাম, মানুষও তো সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশায়।
বাবা বললেন, মানুষের মিশ্রণ ভালো হয় না। মানুষের মিশ্রণ হয় তেল-জলের মিশ্রণ। কিছুক্ষণ পরেই তেল-জল আলাদা হয়ে যায়। আর শয়তানের মিথ্যা হল দুধপানির মিশ্রণ, আলাদা করা যায় না।
আমি বললাম, এক ফোটা লেবুর রস দিলে দুধ-পানি আলাদা হয়ে যায়।
বাবা বললেন, সেই লেবুর পানি সবার কাছে থাকে না মা! এই বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আর তর্ক করব না। তর্ক করার মতো মানসিক অবস্থা আমার না। তুমি এখন যাও। বোনের সঙ্গে তোমার ছবি দেখার কথা, ছবি দেখ।