ইথেন বলল, বাবা, ইবলিশের দেখা যদি পাই তা হলে তাকে কী ডাকবা? ইবলিশ ভাই?
বাবা হতভম্ব হয়ে ইথেনের দিকে তাকালেন। ইথেন সহজভাবে তাকিয়ে রইল। বাবা বললেন, মাগো, তুমি কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস টেনে উঠেছি।
যে-মেয়ে ক্লাস টেনে উঠেছে সে তো মাশাল্লা অনেক বড় মেয়ে। তার কি উচিত। সব সময় ঠাট্টা-ফাজলামি ধরনের কথা বলা?
উচিত না বাবা।
বাবা বললেন, ইবলিশ শয়তান যে এই বাড়িতে আছে আমার এই কথাটা তোমরা গুরুত্বের সঙ্গে নাও। এর ক্ষমতা অনেক বেশি বলেই আল্লাহ্পাক স্বয়ং তার বিষয়ে বারবার সাবধান করেছেন। মা ইথেন তুমি কি জান ইবলিশ কে?
জানি। সে শুরুতে আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র ছিল। একজন বড় ফেরেশতা।
তোমার জানায় সামান্য ভুল আছে। ইবলিশ ফেরেশতা না। সে জিন সম্প্রদায়ের। জিন সম্প্রদায় মানব সম্প্রদায়ের কাছাকাছি-এদের জন্ম-মৃত্যু আছে। তবে ইবলিশের মৃত্যু হবে কেয়ামতের সময়। তার আগে না।
ইথেন আবারো বেফাঁস কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে ইশারায় থামালাম। বাবা বললেন, আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আমাদের খুবই সাবধান থাকতে হবে। শয়তান চলে মানুষের শিরায়-শিরায়। তারা মানুষের সবচেয়ে দুর্বল অংশে আঘাত করে! আমাকে শয়তান কিছু করতে পারছে না। কাজেই সে তোমাদের মাধ্যমে আমার ক্ষতি করতে চেষ্টা করবে। কারণ আমি তোমাদের অত্যন্ত স্নেহ করি। জুলাস মানুষের দুৰ্বল স্থান। কাজেই ইংলিশ আঘাত করবে স্নেহ-ভালবাসার দুর্বল স্থানে।
বাবার কথা শেষ হবার আগেই ইথেন বলল, বাবা আমি উঠি? আমার একটা জরুরি কাজ আছে।
কী কাজ?
টিভিতে x-Fite নামে একটা শো হয়। আমি তার কোনোটাই মিস করি নি। আজকেরটাও করব না।
x-File-এ কী দেখায়?
ভূতপ্ৰেত সুপার ন্যাচারাল এইসব হাবিজাবি।
হাবিজাবি দেখার দরকার কী?
হাবিজাবি আমার ভালো লাগে বাবা! কী করব বলে, আমি মেয়েটাই মনে হয়। হাবিজাবি।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা যাও।
ইথেন তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেল। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে মা, তুমিও যাও।
হাবিজাবির দিকে ইথেন খুবই ঝুঁকে পড়েছিল। সে সিগারেট খাওয়া ধরেছিল। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় সে তার ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে প্রথমেই আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলত-আপা খাবি? একটা টান দিয়ে দ্যাখ না? এমনভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ছেলেরা যে-জিনিস খেতে পারে মেয়েরাও পারে। তোর ইচ্ছা হলে বাবাকে বলে দে। যা, এখনই গিয়ে বল। আমি কোনোকিছু কেয়ার করি না। বাবা কী করবে, আমাকে মারবে? মারলে মারুক।
সে যে কোনো কিছুই কেয়ার করে না তার প্রমাণ কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া গেল। এক রাতে সে তার ব্যাগ থেকে কোকের ক্যানের মতো ক্যান বের করে বলল, আপা এক চুমুক খেয়ে দেখাবি?
আমি বললাম, কী?
বিয়ার। সামান্য অ্যালকোহল আছে। সেটা না-থাকার মতো।
তুই বিয়ার খাচ্ছিস?
হুঁ। অসুবিধা কী? রোজ তো খাচ্ছি না। এক দিন একটু চেখে দেখব। ইউরোপ আমেরিকায় আমার বয়সি মেয়েরা পানি খায় না। বিয়ার খায়।
বিয়ার তোকে কে দিয়েছে?
দিয়েছে একজন। নাম দিয়ে কী করবি?
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে তার বিছানায় পা বুলিয়ে বসেছে। বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিচ্ছে, পা দোলাচ্ছে। তার মুখ হাসি-হাসি। আমি মনে-মনে ভাবলাম বাবার কথাই মনে হয় ঠিক। আমাদের দুই বোনের মধ্যে দিয়ে শয়তান কাজ করতে শুরু করেছে।
আমার উচিত ছিল ইথেনের কর্মকাণ্ড বাবাকে জানানো। আমি তা জানালাম না। এখানেও হয়তো শয়তানের কোনো হাত আছে।
এর মাসছয়েক পরের কথা। বর্ষাকাল। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আমরা দুই বোন ছাদে বৃষ্টির পানিতে গোসল সেরে ফিরেছি। ইথেন আমাকে বলল, আপা, আমার যদি কোনো মেয়ে হয় তার নাম কী হওয়া উচিত? কেমিস্ট্রি নাম। প্রপেন নামটা তোর পছন্দ হয়? ছেলে হলেই-বা কী নাম হবে? তুই যা তো, বাবার কাছ থেকে জেনে আয়।
আমি বললাম, বিয়ে হোক। ছেলেমেয়ে হোক তখন বাবার কাছ থেকে জানব।
আমার এখনই জানা উচিত।
এখনই জানা উচিত কেন?
ইথেন বলল, এখনই জানা উচিত। কারণ আমার পেটে বাচ্চা।
আমি বললাম, ফাজলামি করিস না।
ইথেন বলল, ফাজলামি করছি না। যা বাবাকে গিয়ে বল। এক্ষুনি বল।
আমি বললাম, ইথেন সবকিছুর সীমা আছে।
ইথেন বলল, সবকিছুর সীমা আছে তোকে কে বলল? মহাকাশের সীমা নেই। মানুষের ভালবাসার সীমা নেই। ঘৃণার সীমা নেই। অহংকারের সীমা নেই।
চুপ।
আমি চুপ করব না। আপা আমি নাম চাই। বাবা যদি নাম না দেন তা হলে আমি ইবলিশের কাছে নাম চাইব। সেটা কি ভালো হবে? ইবলিশ নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে যদি নাম দেয় কিবলিশ সেটা ভালো হবে? লোকে হাসবে না?
বাবার ঘর অন্ধকার
বাবার ঘর অন্ধকার। দরজা-জানালা বন্ধ। ঘরের বাতি নেভানো। তবে জায়নামাজের পাশে মোমবাতি জ্বলছে। ঘরে আগরবাতির গন্ধ। আগরবাতি দেখা যাচ্ছে না। তবে জুলছে নিশ্চয়ই। তিনি মোমবাতির দিকে পেছন ফিরে তসবি টানছিলেন। আমি তার সামনে বসতেই তিনি আমার দিকে ফিরলেন। পেছন থেকে মোমবাতি এনে দুজনের সামনে রাখতে–রাখতে বললেন, যে জটিল কথাটা বলতে এসেছিস বলে ফেল। কী বলবি সেটা মনে হয় আমি জানি। মোমবাতির আলোতে বলতে অসুবিধা হলে মোমবাতি নিভিয়ে দিই।
আমি বললাম, বাতি নেভাতে হবে না। বাবা তসবি টানা বন্ধ করলেন না। আমার দিকে তাকালেনও না। তিনি তাকিয়ে রইলেন মোমবাতির দিকে। আমি কথা শেষ করলাম। তাঁর চেহারায়, চোখ-মুখের ভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন হল না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, মা, দেখি আতরের শিশিটা এনে দাও তো।