সায়রা বলল, পুরোটা আমি লিখে এনেছি। আপনার কাছে খাতাটা রেখে যাচ্ছি। খাতায় আমার টেলিফোন নাম্বার দেওয়া আছে। যখন পড়া শেষ হবে আমাকে টেলিফোন করবেন। আমি চলে আসব। আবার যদি পড়তে-পড়তে আপনার খটকা লাগে তা হলেও নিজে এসে খটকা দূর করব।
সায়রার ড্রাইভার এসেছে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে। সায়রা বলল, কাপ দুটা থাকুক। এই বাড়িতে ভালো কাপ নেই! আবার যখন আসব-এই কাপে চা খাব।
মিসির আলি খাতাটা হাতে নিলেন। প্রায় এক শ পৃষ্ঠা গুটিগুটি করে লেখা। পুরোটাই ইংরেজিতে। শিরোনাম—
Autobiography of an unknown young girl.
সায়রা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, লেখাটার টাইতেল আমি একজনের কাছ থেকে নকল করেছি। নীরদ সি চৌধুরীর একটা বই আছে, নাম–
Autobiography of an unknown Indian. সেখান থেকে নেওয়া।
মিসির আলি বললেন, তোমার পড়াশোনার সাবজেক্ট কি ইংরেজি?
জি না। কেমিষ্ট্রি। আমি স্কটল্যান্ডের এবারডিন ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে পিএইচ. ডি. করেছি। বুঝতে পারছি আপনি ছোটখাটো ধাক্কার মতো খেয়েছেন। আপনি আমাকে অনেক অল্পবয়সি মেয়ে ভেবেছিলেন; আমার বয়স ত্রিশ। এখন আপনাকে আরেকটা ছোট্ট ধাক্কা দিতে চাই। দেব?
দাও।
আমি একটা সিগারেট খাব। আপনি যদি অনুমতি দেন।
অনুমতি দিলাম।
সায়রা তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে সিগারেট বের করল। লাইটার বের করল। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল।
মিসির আলি তেমন কোনো ধাক্কা খেলেন না। মেয়েটা ধূমপানে অভ্যস্ত না। এই কাজটা যে সে তাকে চমকে দেবার জন্য করেছে তা বোঝা যাচ্ছে। সিগারেটের প্যাকেটটা নতুন। লাইটার ধরাবার কায়দাও সে জানে না। সিগারেটের ধোয়া ফুসফুসে নিয়ে সে কাশছে। চোখের মণি লাল হয়ে গেছে।
আপনি কি আমার সিগারেট খাওয়া দেখে রাগ করছেন?
না।
বিরক্ত হচ্ছেন?
না।
প্লিজ রাগ করবেন না। বিরক্তও হবেন না। সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার আমি আপনার জন্য এনেছি। হঠাৎ কেন জানি ইচ্ছা হল আপনাকে আরেকটু চমকাই! চাচা এখন আমি যাই?
যাও!
আপনি কিন্তু খাতাটা আজ রাতেই পড়তে শুরু করবেন।
মিসির আলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
যাই বলেও সায়রা দাঁড়িয়ে আছে। যাচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, তুমি কি আরো কিছু বলবে?
সায়রা বলল, আমি আপনাকে যেরকম ভেবেছিলাম আপনি সেরকম না।
মিসির আলি বললেন, কীরকম ভেবেছিলে?
অহংকারী, রাগী। আমি চিন্তাই করি নি। আপনি এত সহজে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। থ্যাংক য়্যু।
সায়রার লেখা অটোবায়োগ্রাফির সরল বঙ্গানুবাদ
বাবা আমার নাম রেখেছিলেন মিথেন। আমার নাম মিথেন, আমার ছোট বোনের নাম ইথেন।
ছোটবেলায় কেউ আমার নাম জিজ্ঞেস করলে মজার ব্যাপার হত। প্রশ্ন কর্তা নাম শুনে অবাক হয়ে বলত–এমন নাম তো শুনি নি! এর অর্থ কী?
আমি বলতাম মিথেন হল হাইড্রোকার্বন। এর কেমিক্যাল ফর্মুলা CH4, আমার ছোট বোনের নাম ইথেন। ইথেনের কেমিক্যাল ফর্মুলা হল CH3 – CH3
প্রশ্নকর্তা আরো অবাক হয়ে বলত, এমন অদ্ভুত নাম কে রেখেছে?
আমি বলতাম, বাবা। তিনি কেমিস্ট্রির টিচার।
আমার বাবার নাম হাবিবুর রহমান। ছোটখাটো মানুষ। কুঁজো হয়ে হাঁটতেন যখন তখন তাকে আরো ছোট দেখাত। কলেজের ছাত্ররা তাকে ডাকত। ট্যাবলেট স্যার। আমার ছোট বোন ইথেন ছিল ফাজিল স্বভাবের মেয়ে। সে একদিন বাবাকে ট্যাবলেট বাবা ডেকে ফেলেছিল। বাবা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাঁর ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন–এটা কী বললা গো মা?
ইথেন বলল, আর কোনোদিন বলব না বাবা। এই বলেই সে কাঁদতে শুরু করল। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না বন্ধ করলেন।
আমার ট্যাবলেট বাবা মানুষ হিসেবে ভালো ছিলেন। শুধু ভালো না একটু বেশিরকম ভালো। তিনি আমাদের দুই বোনকে খুবই আদর করতেন। কিছু-কিছু মানুষ আদর স্নেহ ভালবাসা এইসব মহৎ গুণ নিয়ে জন্মায় কিন্তু প্ৰকাশ করতে পারে না। বাবা ছিলেন সেই দলের। মার মৃত্যুর পর বাবা আর বিয়ে করেন নি কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল সৎমায়ের সংসারে আমরা দুই বোন কষ্ট পাব।
ধৰ্মকর্মের প্রতি বাবার কোনো ঝোঁক আগে ছিল না। মার মৃত্যুর পর তিনি এইদিকে ঝুকে পড়েন। নামাজ, নফল রোজা, গভীর রাতে জিগির এইসব চলতে থাকে। তিনি দাড়ি রাখলেন, চোখে সুরমা দেওয়া শুরু করলেন। কলেজের ছাত্ররা তাঁর নতুন নামকরণ করল ট্যাবলেট হুজুর।
অতিরিক্ত ধৰ্মকৰ্মই সম্ভবত বাবার মধ্যে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এল—তিনি শুচিবায়ু রোগে পড়লেন। অজু করার পরপরই তাঁর মনে হত যে—বদনায় তিনি অজু করেছেন সেই বদনা নাপাক। কাজেই বদনা ধুয়ে আবার নতুন করে অজু। শুচিবায়ু খুব খারাপ রোগ–এই রোগ কখনো স্থির থাকে না, বাড়তে থাকে। বাবার এই রোগ বাড়তে থাকল। তার সঙ্গে যুক্ত হল ইবলিশ শয়তান-দেখা রোগ। তিনি মাঝে মধ্যেই আমাদের বাড়ির আনাচে-কানাচে ইবলিশ শয়তানকে দেখতে শুরু করলেন। ইবলিশ শয়তান নাকি নিজ দায়িত্বে এই বাড়িতে এসে উঠেছে। তার একটাই কাজ-বাবাকে ধর্মের পথ থেকে সরিয়ে আনা।
একদিনের কথা। বাবা মাগরিবের নামাজের পর আমাদের দুই বোনকে ডেকে পাঠালেন। আমরা অবাকই হলাম, কারণ মাগরিব থেকে এশ পর্যন্ত বাবা কারোর সঙ্গে কথা বলতেন না। জায়নামাজে বসে তসবি টানতেন।
আমরা বাবার সামনে বসলাম। তিনি জায়নামাজে বসে আছেন। আমরা বসেছি জয়নামাজ থেকে একটু দূরের পাটিতে। দরজা-জানালা বন্ধ। ঘর অন্ধকার। বাবার সামনে আগরদানে আগরবাতি জ্বলছে। বাবা বললেন, মাগো তোমাদের একটা বিশেষ কারণে ডেকেছি। কারণটা মন দিয়ে শোন। ইবলিশ স্বয়ং এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, তার বিষয়ে সাবধান। আমি কয়েকবারই তার সাক্ষাৎ পেয়েছি। তোমরাও নিশ্চয়ই পাবে। যাতে তোমরা ভয় না পাও এইজন্য আগেভাগে সাবধান করলাম।