সায়রা চা খাবে?
না।
চা খাও। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। এস কিছুক্ষণ মন খুলে গল্প করি। আমার ধারণা তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
দেখা হবে না কেন?
দেখা হবে না কারণ দেখা হবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ইবলিশ শয়তানঘটিত যে-সমস্যা তার সমাধান করেছি। সমাধান জানার পর তুমি যে আমার কাছে আসবে তা মনে হয় না।
সমাধান করে ফেলেছেন?
হ্যাঁ করেছি।
আপনি কি আমার লেখা পুরোটা পড়েছেন?
আমি থার্ড চ্যাপ্টার পর্যন্ত পড়েছি।
আরো দুটা চ্যাপ্টার আছে। সেই দুই চ্যাপ্টার পড়বেন না?
না।
না কেন?
তুমি লেখাটা মূলত লিখেছ আমাকে কনফিউজ করার জন্য। আমি যতই পড়ছি ততই কনফিউজ হচ্ছি। ইবলিশ যেমন করে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশায় তুমি নিজেই তা করেছ। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য গোপন করেছ। আবার অতি তুচ্ছ তথ্য খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছ।
সায়রা বানু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনার সমাধানটা কী বলুন।
মিসির আলি বললেন, সমাধান তুমি নিজেও করেছ। অনেক আগেই করেছ। তাই না?
হ্যাঁ।
তা হলে আমার কাছে এসেছ কেন?
কনফারমেশনের জন্য। আপনার যতটা আস্থা আপনার বুদ্ধির ওপর আছে আমার ততটা নেই।
মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে—দাঁড়াতে বললেন, চা নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে কথা বলি।
সায়রা বলল, আগে কথা শেষ হোক তারপর চা খাবেন।
মিসির আলি বসে পড়লেন। সায়রা বলল, চা এখন খেতে চাচ্ছি না কেন আপনাকে বলি। চা খেলেই আপনি সিগারেট ধরবেন। এমনিতেই আমার শ্বাসকষ্ট। সিগারেটের ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টটা বাড়বে। এখন বলুন আপনার সমাধান।
মিসির আলি বললেন, তুমি তোমার স্বর পুরুষদের মতো করতে পার তাই না?
সায়রা বানু চমকাল না। সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ।
মিসির আলি বললেন, তোমার বোন যখন আলাদা ঘরে থাকা শুরু করল তুমি তখন জানালার বাইরে থেকে পুরুষের মতো গলা করে কথা বলতে। ইবলিশ শয়তান সেজে কথা বলা।
সায়রা বলল, হ্যাঁ। ও আলাদা থাকতে গেল তখন আমার খুব রাগ লাগল। আমি তাকে ভয় দেখিয়েছিলাম, যাতে সে আবার আমার সঙ্গে থাকতে শুরু করে।
ইবলিশ শয়তান সেজে তুমি তোমার বাবার সঙ্গেও কথা বলেছ?
হ্যাঁ বলেছি।
ওনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছ?
হ্যাঁ। বাবাকে ভয় দেখানো জরুরি ছিল।
তুমি তোমার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে যে—বৰ্ণনা দিয়েছ সে বর্ণনাটা ভুল। তুমি লিখেছ ছাদের ঠিক যে—জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে ইথেনের মৃত্যু হয়েছে তোমার মার মৃত্যুও সেখান থেকে পড়েই হয়েছে। অথচ তোমার মার মৃত্যু এ বাড়িতে হয় নি।
সায়রা বলল, এ বাড়িতে হয় নি এটা ঠিক তবে তাঁর মৃত্যু ছাদ থেকে পড়েই হয়েছিল।
মিসির আলি বললেন, তোমাদের বাড়ির পুরোনো ইলেকট্রসিটি বিলগুলি ঘেঁটে আমি একটা মজার তথ্য পেয়েছি। দেখলাম পাঁচ মাস তোমরা এই বাড়িতে ছিলে না।
সায়রা বলল, এই তথ্যটা মজার কেন?
এই তথ্যটা মজার কারণ তখন প্রশ্ন আসে এই পাঁচ মাস তোমরা কোথায় ছিলে। হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে কেন?
সায়রা বলল, আপনি ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছেন যে আমরা ইথেনের বাচ্চা ডেলিভারির জন্য বাইরে গিয়েছি। কিন্তু আমি তো খাতায় লিখেছি ইথেনের পোষ্টমর্টেম করা হয়। তার পেটে কোনো বাচ্চা পাওয়া যায় নি।
মিসির আলি বললেন, এমন কি হতে পারে না যে ঐ পাঁচ মাস তোমরা গোপনে কোথাও ছিলো। ইথেনের বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাটাকে কোথাও দত্তক দিয়ে তোমরা চলে এসেছ।
সায়রা বলল, চাচা। আপনি চা খেতে চেয়েছিলেন চা খান। মেয়েটা কোথায় ওকে বলুন চা দিতে।
মিসির আলি বললেন, মেয়েটিকে আমি ইচ্ছা করেই আজ বাসায় রাখি নি। আমি চাচ্ছিলাম না আমাদের কথাবার্তার সময় সে থাকুক। আমার এক বন্ধু আছে নাম হারুন বেপারী। নাসরিনকে পাঠিয়েছি ঐ বাড়িতে। আজ সারা দিন সে ঐ বাড়িতে থাকবে। চা আমাকেই বানাতে হবে। সায়রা তোমার জন্য কি বানাব?
হ্যাঁ।
মিসির আলি চা এনে দেখেন সায়রা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। তিনি সায়রার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। সায়রা নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিল। ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি ইচ্ছা করলে সিগারেট ধরাতে পারেন।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন।
সায়রা বলল, কথা শেষ করুন।
মিসির আলি বললেন, ইথেনের মৃত্যুর পর রমনা থানায় একজন মহিলা এবং একজন পুরুষের টেলিফোন কলটা খুবই রহস্যজনক। আমি তোমাদের ঐ বাড়িটি দেখতে গিয়েছি। গাছগাছালিতে ঢাকা বাড়ি। এই বাড়ির ছাদে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা দূরের অ্যাপার্টমেন্ট হাউস থেকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অথচ এর মধ্যে একজন দেখে ফেলল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। অন্ধকারে কোনো রঙ দেখা যায় না। কাজেই যে বলেছে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি তাকে দেখতে হয়েছে খুব কাছ থেকে। কিংবা সে জানে যে হত্যাকাণ্ডটি করেছে তার গায়ে ছিল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। ঐ ভয়াবহ দিনে তোমার বাবার গায়ে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি ছিল?
হ্যাঁ।
মিসির আলি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, টেলিফোন দুটা আমার ধারণা তুমি করেছ প্রথমে মেয়ের গলায় তার পরপরই পুরুষের গলায়।
আমি টেলিফোন করব কেন?
দুটা কারণে করবে। যাতে তোমার বাবা তোমাকে সন্দেহ না করেন। যাতে তোমার বাবার ধারণা হয় কাজটা ইবলিশ শয়তান করেছে। তোমার বাবার রূপ ধরে সে ছাদে গেছে। তোমার বোনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে।
সায়রা বলল, আপনার ধারণা ইথেনকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি?
মিসির আলি বললেন, আমি এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত।