মেয়েটি আপনার রান্নাঘর কোথায় বলেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছে। রান্নাঘরে যাবার অনুমতি চায় নি। এর অর্থ, এই মেয়ে অনুমতি নিয়ে কোনোকিছু করায় অভ্যস্ত না। যে-বাড়িতে সায়রা বাস করে সেই বাড়ির কর্ত্রী সে নিজে।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। অনেকগুলো ছোট-ছোট সিদ্ধান্ত থেকে একটা বড় সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সেটা কোনো জটিল কাজ না।
সায়রা নামের মেয়েটি অতি ধনবান গোত্রের একজন। সে গাড়ি ছাড়া আসবে না। সে অবশ্যই গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়ি কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছে। মেয়েটির ইফতার গাড়িতেই আছে। ইফতারের সময় হলেই গাড়ির ড্রাইভার ইফতার নিয়ে আসবে। এই ব্যাপারে মেয়েটি নিশ্চিত বলেই ইফতারের ব্যাপারে মাথা ঘামায় নি।
চাচা অ্যাপনায় চা।
মিসির আলি চায়ের কাপ হাতে নিলেন। সায়রা বলল, আমি আগামীকাল লোক পাঠাব। সে এসে রান্নাঘর পরিষ্কার করে দেবে। আমি আমার জীবনে এমন নোংরা। রান্নাঘর দেখি নি।
সায়রা আগের জায়গায় বসল। হাতঘড়িতে সময় দেখল। মিসির আলি বললেন, ইফতারের সময় হলেই তোমার ড্রাইভার ইফতার দিয়ে যাবে—আমার এই অনুমান কি ঠিক আছে?
সায়রা বলল, ঠিক আছে। মিসির আলি বললেন, তুমি তোমার বাড়িতে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা রকিৎ-চেয়ারে বসে দোল খাও আমার এই অনুমান কি ঠিক আছে?
হ্যাঁ, ঠিক আছে। আপনাকে আমি যত বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। আপনার বুদ্ধি তারচেয়ে বেশি। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। আমি আপনাকে দয়া করতে বলছি না। আমি আল্লাহ্রপাকের দয়া ছাড়া কারোর দয়া নিই না। আপনার কাজের জন্য আমি যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেব।
তুমি আল্লাহপাকের দয়া ছাড়া কারো দয়া নাও না?
জি না।
আল্লাহপাক তো সরাসরি দয়া করেন না। তিনি কারো-না-কারো মাধ্যমে দয়া করেন। তুমি অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যাও। তার সেবা তোমাকে নিতে হয়।
আপনি তর্ক খুব ভালো পারেন। আমি আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আমার মূল কথা হচ্ছে, আপনাকে যোগ্য পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।
যোগ্য পারিশ্রমিকটা কী?
উত্তরায় ২৪ শ স্কয়ার ফিটের আমার একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। ফোর বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট। আমি অ্যাপার্টমেন্টটা আপনাকে দিয়ে দেব।
মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটিও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। চোখে চোখ রাখার খেলা মেয়েরা খুব ভালো পারে।
সায়রা বানুর ড্রাইভার ইফতার নিয়ে এসেছে। সে সঙ্গে করে জায়নামাজও এনেছে। টেবিলে সে দুটা চায়ের কাপ এবং ফ্লাঙ্ক রাখল। ফ্লাস্কে নিশ্চয়ই চা আছে। গোছানো ব্যবস্থা।
আজান হয়েছে। মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে মেয়েটির রোজা ভাঙার দৃশ্য দেখলেন। এক গ্রাস পানি খেয়ে সে রোজা ভেঙেই জায়নামাজ নিয়ে বসল। অপরিচিত জায়গায় কেউ নামাজ পড়তে চাইলে প্রথমেই পশ্চিম কোন দিকে জেনে নেয়। সায়রা তা করে নি। তার পরেও পশ্চিমমুখী করে জায়নামাজ পেতেছে। এর অর্থ সে আজ প্রথম এখানে আসে নি। আগেও এসেছে, খোঁজখবর নিয়েছে।
মেয়েটির আচার-আচরণে কোনো জড়তা নেই, অস্পষ্টতা নেই। সে নিজে কী করছে তা জানে। নিজের ওপর তার বিশ্বাস প্রবল। এই বিশ্বাস সে অর্জন করেছে তা মনে হচ্ছে না; বিশ্বাসটা সে মনে হয় জন্মসূত্রেই নিয়ে এসেছে।
সায়রার হাতে চায়ের কাপ। সে আগ্রহ নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মিসির আলি সিগারেট ধরিয়েছেন।
সায়রা বলল, চাচা, আপনি কি আমার প্রস্তাবে রাজি?
মিসির আলি বললেন, কোন প্রস্তাব? সমস্যার সমাধান করব, বিনিময়ে বাড়ি?
হুঁ।
তোমার জানা উচিত সমস্যা সমাধান আমার পেশা না। তা ছাড়া সমস্যার সমাধান আমি সেইভাবে করতেও পারি না। জগতের বড় বড় রহস্যের বেশিরভাগ থাকে অমীমাংসিত। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। রহস্যের মীমাংসা তেমন পছন্দ করে না।
সায়রা শান্ত গলায় বলল, প্রকৃতি রহস্যের মীমাংসা পছন্দ করুক বা না করুক আপনি মীমাংসা পছন্দ করেন। আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এ সছি। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
কেন সাহায্য করব?
আপনি আপনার নিজের অ্যানন্দের জন্য করবেন। সমস্যা সমাধান করে আপনি আনন্দ পান। সমস্যা যত বড় আপনার আনন্দও হয় তত বেশি। এখন আপনার কিছুই করার নেই। আপনি সময় কাটান শুয়ে-বসে, বই পড়ে এবং সস্তার সিগারেট টেনে! মানুষের জীবন যতটা একঘেয়ে হওয়া উচিত আপনার জীবন ততটাই একঘেয়ে। আপনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও সেই একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পাবেন। তার মূল্যও কি কম? বলুন কম?
না, কম না।
আপনি জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। সস্তার একটা ভাড়া বাড়িতে বাস করেন। একটা মাত্র কামরা। ঘরে নিশ্চয়ই এসি নেই। গরমে কষ্ট পান! শীতের সময় বরফের মতো ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে হয়। এখন যদি আপনার চমৎকার একটা ফ্ল্যাট থাকে যে-ফ্ল্যাটে এসি আছে, বাথরুমে গিজার আছে তা হলে ভালো হয় না?
আমি যো-জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত আমার জন্য সেটাই ভালো। ঠিক আছে বাদ দিলাম। আপনার যদি আমার মতো একটা মেয়ে থাকত সেই মেয়ে যদি কাঁদতে-কাঁদতে আপনাকে সমস্যার কথা বলত। আপনি কী করতেন?
তুমি কিন্তু কাঁদছ না।
আপনি বললে আমি কাঁদতে পারি। আমি অতি দ্রুত চোখে পানি আনতে পারি। কেঁদে দেখাব?
বলে তোমার সমস্যা।
সায়রা বলল, থ্যাংক য়্যু স্যার। বলেই সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। এর মধ্যেই সে চোখে পানি নিয়ে এসেছে। মিসির আলি মেয়েটির কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হলেন।