আমি বললাম, খরচ কত?
সে বলল, পাঁচ শ টাকা।
সুপারভাইজারের সঙ্গে দেখা হল। রাতে আমি এই মানুষটাকেই দেখেছিলাম। তালা খোলার পর সে বাড়তি দুশ টাকা নিল।
রাতে আমি একা মৰ্গে ঢুকেছিলাম। দিনে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলাম। মর্গের দৃশ্যও রাতের দৃশ্যের মতো। ছোট-ছোট তিনটা টেবিলে তিনটা ডেডবডি পড়ে আছে। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। বাবা চাপা গলায় বললেন, কোনটা আমার মেয়ে?
সুপারভাইজার বিরক্ত গলায় বলল, মাঝখানেরটা। আপনার কাছে যাবেন না। যেখানে দাঁড়ায়ে আছেন সেখানে দাঁড়ায়ে থাকেন। আমি চাদর খুলে মুখ দেখায়ে দিতেছি। তাড়াতাড়ি বিদায় হন। রিপোর্টিং হয়ে গেলে চাকরি যাবে।
আগে একবার লিখেছি পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে ইথেনের গর্ভে কোনো সন্তান ছিল এমন কিছুই পাওয়া যায় নি। শুধু লেখা ছিল—উচ্চ স্থান হইতে পতন জনিত কারণে মৃত্যু। কোথায় কোথায় আঘাত লেগেছে তার বর্ণনা। তা হলে ইথেন এই কাজটা কোন করল? কোন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল? সে কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল? সে কি ধরে নিয়েছিল সে প্ৰেগনেন্ট? মনোবিদ্যায় এরকম রোগের উল্লেখ আছে।
আমি ইথেনকে নিয়ে এরকম একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবির নাম The Yellow Snake, সেই ছবিতে এক মহিলার হঠাৎ ধারণা হল তিনি প্রোগনেন্ট। তার ভেতর প্রোগনেসির সমস্ত লক্ষণ প্ৰকাশিত হল। ডাক্তারের কাছে ইউরিন টেস্ট করালেন। সেই টেস্ট্রেও পজিটিভ পাওয়া গেল। তখন মহিলা স্বপ্নে দেখলেন তাঁর পেটে যে সন্তান এসেছে সে কোনো মানবশিশু না। একটা সাপ। ভয়াবহ ছবি।
ইথেনের কি একই সমস্যা ছিল? ভুক্তিার পেটে সন্তান এই বিষয়ে সে যে নিশ্চিত ছিল তার একটা প্ৰমাণ আমার কাছে আছে। সে তার সন্তানকে একটি চিঠিও লিখে রেখে গিয়েছিল। চিঠিটা আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি।
প্রিয় HCHO,
হ্যালো। তোমার নাম পছন্দ হয়েছে? ফরম্যালডিহাইড়। আমি তোমার মা আমার নাম ইথেন। আমি সাধারণ হাইড্রোকার্বন। অথচ তুমি হলে সুপার রিঅ্যাকটিভ ফরমালডিহাইড। পানিতে যদি ইথেন ছেড়ে দাও পানির কিছুই হবে না। পানি পানির মতো থাকবে। ইথেন থাকবে ইথেনের মতো। আর যদি পানিতে ফরমালডিহাইড ছাড়া-কত না কাণ্ড হবে।
তুমি পৃথিবীতে আসবে কত না কাণ্ড ঘটানোর জন্য। আফসোস তোমার এই কত না কাণ্ড দেখার সুযোগ আমার হবে না। কারণ আমি বেঁচে থাকব না।
ইতি তোমার মা।
মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত এগারোটা দশ।
তাঁর খাটের মাথায় নাসরিন বই-খাতা নিয়ে বসেছে। মিসির আলি যখন পড়েন। সেও তখন পড়ে। মিসির আলি আঁকে এর মধ্যেই বর্ণ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছোট শব্দ সে এখন পড়তে পারে। লেখাপড়া শেখার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ মিসির আলিকে মুগ্ধ করেছে।
নাসরিন বলল, খালুজান চা খাবেন? চা বানাব?
মিসির আলি বললেন, চা এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।
নাসরিনের চোখে-মুখে আনন্দের আভাস দেখা গেল। এই মানুষটার জন্য যে কোনো কাজ করতে পারলেই তার ভালো লাগে।
নাসরিন।
জি খালুজান।
তোমার বুদ্ধি কেমন নাসরিন?
বুদ্ধি ভালো খালুজান।
কেমন বুদ্ধি পরীক্ষা হয়ে যাক। একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব দেখি জবাব দিতে পার কি না।
কহেন কবি কালিদাস
পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ
থাকলে কোথায় পেতে?
পারব না খালুজান।
তা হলে তো বুদ্ধি কম। আমি নিজেও পারছি না। আমারও তোমার মতোই বুদ্ধি কম।
নাসরিন গম্ভীর গলায় বলল, বুদ্ধি কম থাকন ভালো খালুজান।
মিসির আলি বললেন, বুদ্ধি কম থাকা মোটেই ভালো না। মানুষের বুদ্ধি হওয়া উচিত ক্ষুরের মতো।
ক্ষুরের মতো বুদ্ধি করে বলে?
ক্ষুরে যেমন ধার থাকে বুদ্ধিতেও থাকবে সেরকম ধার। যেমন সায়রা বানু। তোমার কি মনে হয় মেয়েটার বুদ্ধি বেশি না?
উনার বুদ্ধি খুবই ভালো কিন্তু উনার মাথাত গণ্ডগোল আছে। উনারে আমি বেজায় ভয় পাই।
কেন?
উনি রাইতে কেমন জানি করে। ঘুমায় না। কার সাথি যেন কথা কয়। পুরুষের মতো গলায় কথা কয়।
তুমি জান কীভাবে?
প্রথমে আমি উনার ঘরেই ঘুমাইতাম। আপা থাকে একা। উনার ঘরের মেঝেতে কম্বলের একটা বিছানা ছিল আমার জন্য। শেষে অ্যাপারে বলেছি আমি এইখানে থাকব না। আমার ভয় লাগে। তখন আপা আমারে অন্য ঘরে পাঠায়ে দিয়েছিল।
সায়রা মাঝে মাঝে পুরুষের গলায় কথা বলত?
জি।
কী বলত?
কী বলত জানি না। ইংরেজিতে কথা বলত। খালুজান আমারে ইংরেজি পড়া শিখাইবেন?
অবশ্যই শিখাব। তার আগে আসি চেষ্টা করে দেখি দুজনে মিলে ধাঁধার অর্থ বের করতে পারি কি না। কাহেন কবি কালিদাস … এই বাক্যটার কি কোনো রহস্য আছে? তিনটা শব্দই শুরু হয়েছে ক দিয়ে। কয়ের অনুপ্রাস। তিনটা ক। অঙ্কের কোনো ধাঁধা না তো?
খালুজান কালিদাস কে?
কালিদাস ছিলেন বিরাট কবি। মেঘদূত, শকুন্তলা এই রকম ছয়টা অতি বিখ্যাত কবিতার বই লিখেছিলেন। উনি মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি। বিক্ৰমাদিত্যের আরেক নাম দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত। বিক্রমাদিত্য নিজে ছিলেন পিশাচসিদ্ধ। একবার এক পিশাচ তাকে তিনটা প্রশ্ন করেছিল। পিশাচ বলেছিল এই তিনটা প্রশ্নের কোনো একটার জবাব ভুল দিলে আমি তোমাকে হত্যা করব। আর যদি তিনটা প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পার আমি তোমাতে বশ হব। বিক্ৰমাদিত্য তিনটা প্রশ্নেরই জবাব দিতে পেরেছিলেন।
প্রশ্নগুলি কী খালুজান?
প্রশ্নগুলি এই মুহুর্তে মনে নাই। এইটুক মনে আছে প্রশ্নগুলি ছিল রহস্যময়। মহারাজা বিক্ৰমাদিত্যের উত্তর ছিল সহজ-সরল।