তা হলে এক কাজ কর। খুব বুদ্ধি আছে এমন কারোর কাছে যা।
খুব বুদ্ধি আছে এমন কাউকে আমি চিনি না।
এখন চিনিস না পরে চিনবি। অতি বুদ্ধিমান একজন মানুষের সঙ্গে তোর পরিচয় হবে। তার সাহায্য চাইবি।
বুঝব কী করে সে অতি বুদ্ধিমান?
তাকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করবি! ব্দুখবি ধাঁধার জবাব দিতে পারে কি না। প্রথম শুরু করবি সহজ ধাঁধা দিয়ে তারপর কঠিনের দিকে যাবি। আপা এই ধাঁধাটা দিয়ে শুরু কর–
কহেন কবি কালিদাস
পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ
থাকলে কোথায় পেতে?
ইথেন হাসছে। সে আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। হাসিখুশি গল্পবাজ মেয়ে। সে শব্দ করেই হাসছে। পাশের ঘরে নিশ্চয়ই সেই হাসির শব্দ পৌঁছেছে। বাবা এবং তার পীর সাহেব কোরান পাঠ বন্ধ করেছেন। বাবা উঠে আসছেন। তাঁরা পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ইথেন বলল, আপা যাই।
বাবা ঘরে ঢুকে ক্লান্ত গলায় বললেন, হাসছিস কেন মাঃ শরীর খারাপ লাগছে? মাথায় যন্ত্রণা? দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাক মা। তিনি আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আমি কাঁদতে শুরু করেছি। কিন্তু আমার কান্নার শব্দ হাসির মতো শুনাচ্ছে।
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, তুই কঁদেছিলি? অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছিল কেউ একজন হাসছে। বিপদে-আপদে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। কী শুনতে কী শোনে।
আমি বললাম, বাবা একটা কাজ করবে? আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাবে? আমি মর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব।
বাবা বললেন, ঠিক হবে না রে মা।
আমি বললাম, কেন ঠিক হবে না? অবশ্যই ঠিক হবে। তোমার মেয়েটা একা পড়ে আছে। একা-এক ভয় পাচ্ছে।
বাবা বললেন, এত রাতে কীভাবে যাব?
আমি বললাম, রিকশা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর যদি না পাওয়া যায় আমরা হেঁটে यांदा!
বাবা বললেন, পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে দেখি।
আমি বললাম, ওনাকে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই বাবা। ওনার মেয়ে মর্গে পড়ে নেই। তোমার মেয়ে পড়ে আছে। বাবা তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর সে খুবই ভয় পাচ্ছে।
তুই ওখানে গিয়ে কী করবি?
আমি একটা জায়নামাজ নিয়ে যাব। মর্গের বারান্দায় জায়নামাজ বিছিয়ে সূরা ইয়াসিন পড়ব।
রাত তিনটায় আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে উপস্থিত হলাম। দারোয়ান গেট খুলে দিল। সে আমাদের দেখে মোটেই অবাক হল না। সে নিশ্চয়ই আমাদের মতো অনেককে এভাবে আসতে দেখেছে। সে সহজ স্বাভাবিক গলায় পশ্চিম কোনদিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, অজুর পানি লাগব? আমি বললাম, আমার বোনের ডেডবডি মর্গে আছে। তাকে একনজর দেখা কি সম্ভবঃ দারোয়ান বলল, নিয়ম নাই। আমি বললাম, ভাই একটা খোঁজ নিয়ে দেখেন না সম্ভব কি না।
সুপারভাইজার সাব হুকুম দিলে তালা খুলতে পারি। কাছে যাইতে পারবেন না দূর থাইক্যা দেখবেন। তালা খুলনের জন্য খরচ দিবেন।
খরচ কত?
পাঁচ শ টেকা লাগব।
পাঁচ শ টাকা আমি দেব।
দেখি সুপারভাইজার সাব আছে কি না। উনার হুকুম বিনা পারব না। এক হাজার টাকা দিলেও পারব না। আমার চাকরি বিলা হয় যাইব।
বাবা জায়নামাজ বিছিয়ে সূরা ইয়াসিন পড়া শুরু করেছেন। তাঁর পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে তসবি টানছেন। আমি অপেক্ষা করছি সুপারভাইজারের জন্য।
সুপারভাইজার সাহেবকে পাওয়া গেল। তিনি চাবি হাতে দরজা খুলে দিতে এলেন। আমি পাঁচ শ টাকার একটা নোট তার হাতে দিলাম। তিনি বললেন, আরো দুই শ লাগবে। আমার পাঁচ শ দারোয়ানের দুই শ।
আমি আরো দুশ টাকা দিলাম। সুপারভাইজার সাহেবের সঙ্গে মৰ্গে ঢুকলাম। মর্গে এক শ পাওয়ারের একটা বাতি জুলছে। মর্গে তিনটা ডেডবডি। তিনটাই তিনটা আলাদাআলাদা টেবিলের উপর। প্রতিটা ডেডবডি সাদা কাপড়ে ঢাকা! ইথেন বলেছিল তাকে রাখা হয়েছে একটা বাক্সের ভেতর এটা ঠিক না। ঘরের ভেতর ফিনাইলের কড়া গন্ধ।
সুপারভাইজার বললেন, ইথেন আছে মাঝখানের টেবিলে।
আমি চমকে সুপারভাইজারের দিকে তাকলাম। ইথেন নাম সুপারভাইজারের জানার কথা না। আমি চাপা গলায় বললাম, আপনি কে?
সুপারভাইজারের ঠোঁটের কোণে হাসি। আমি বললাম, আপনি কে?
বোনকে দেখতে আসছেন দেখেন। এত প্রশ্ন কী জন্য? তবে না দেখলে ভালো করবেন।
আপনি কে?
আমি তোমার স্যার। আমার নাম রকিব। আমি তোমার সঙ্গে ঘষাঘষি খেলা খেলতাম। এখন চিনেছ?
হ্যাঁ চিনেছি।
মরা মানুষের সাথে আমার কোনো ব্যবসা নাই! আমার ব্যবসা জীবিত মানুষের সাথে তারপরেও তোমার খাতিরে আসছি। বোনকে দেখার যখন এত শখ তখন দেখ।
এই সময় একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল। সাদা চাদরের ভেতর থেকে ইথেন বলল, আপা খবরদার আমাকে দেখিস না। খবরদার না।
আমি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি ইথেনের বিছানায় শুয়ে আছি! আমার গায়ে চান্দর। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। পাশের ঘর থেকে বাবার সুরা ইয়াসিন পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাবার পীর সাহেব একমনে জিগির করছেন। হাসপাতালের মৰ্গে আমার যাওয়া, ইবলিশের সঙ্গে দেখা হওয়া, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া, সবই আমার কল্পনা কিংবা স্বপ্ন।
এখানেও সামান্য সমস্যা আছে। সামান্য সমস্যা বলা ঠিক হবে না বেশ বড় সমস্যা। হাসপাতালের মৰ্গে আমি বাবাকে নিয়ে পরদিন তোরে যাই। যে দারোয়ানকে রাতে দেখেছিলাম। তাকেই দেখি। সে ঠিক রাতে যেরকম বলেছে সেইভাবে বলেসুপারভাইজার সাব হুকুম দিলে তালা খুলতে পারি। কাছে। যাইতে পারবেন না। দূর থাইকা দেখবেন। তালা খুলনের জন্য খরচ দিবেন।