আমি বললাম, কীভাবে সাবধান থাকব?
বাবা বললেন, দমে-দমে আল্লাহ্র নাম নিবি। কিছুক্ষণ পরে-পরে আয়তুল কুরাসি পড়ে হাততালি দিবি। হাততালির শব্দ যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত ইবলিশ আসবে না। ঘরে সব বাতি জ্বালিয়ে রাখবি। ঘর যেন অন্ধকার না থাকে। ইলেকট্রিক বালু। জুলছে। জুলুক। হারিকোনও জ্বালিয়ে রাখ।
আমি চাচ্ছিলাম ইবলিশ শয়তান আসুক। তার সঙ্গে কথা বলি। দেখি সে আসলে কী চায়। আজ তার আসতে সমস্যা নেই। বাড়ি খালি। খালি বাড়িতে আমি একা হাঁটছি।
ইবলিশ শয়তান এল না। রাত বারোটার দিকে বাবা ফিরলেন। পুলিশের জিপ এসে বাবাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। রমনা থানার সেকেণ্ড অফিসার ছিল বাবার ছাত্র। তার কারণেই বাবা বিনা ঝামেলায় ছাড়া পেয়ে গেলেন। ইথেনের ডেডবডি পাওয়া গেল না। তাকে রাখা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মৰ্গে। তার পোষ্টমর্টেম হবে। পরদিন সকাল দশটায়। পোষ্টমর্টেম হবার আগে আমাদের কিছু করার নেই।
বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার যে পীর সাহেবের কাছে যেতেন। ওনার কাছে খবর পৌছেছিল। উনি রাত একটার দিকে চলে এলেন। দোয়া-দরুদ পড়ে বাড়ি বন্ধন করলেন। বসার ঘরের মেঝেতে বিছানা করা হল। বিছানায় জয়নামাজ বিছানো হল। আগরবাতি জ্বালানো হল। বাবা তাঁর পীর সাহেবকে নিয়ে কোরান শরিফ পাঠ করা শুরু করলেন। বাবার এই পীর সাহেবকে আমার পছন্দ হল। তিনি সত্ত্বনাসূচক কোনো কথাবার্তায় গেলেন না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একটা কাজ হাতে নিয়ে এসেছেন। কাজটা সুন্দর মতো করবেন। এর বেশি কিছু না। আমাকে তিনি শুধু একটি কথাই বললেন, মাগো! সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
রাত কত হয়েছে আমি জানি না। আমি বসে আছি ইথেনের ঘরে। টেবিলল্যাম্প জুলছে। টেবিলল্যাম্পের আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই। ইথেনের বিছানা এলোমেলে। দুটা বালিশের একটা মেঝেতে। খাটের নিচে গাদা করে রাখা কাপড়। ধোপার বাড়িতে যাবার জন্য আলাদা করে রাখা। দেওয়ালে ইথেনের ছোটবেলার আঁকা ছবি। চারটা ছবি। ফ্রেম করে বাঁধানো। গ্রাম ঘর বাড়ি। নদীতে সূৰ্য অস্ত যাচ্ছে। রাখাল বালক বাঁশি বাজাচ্ছে। আমাদের দু বোনের একটা ফটোগ্রাফও আছে। কক্সবাজারে সমুদ্রে নেমেছি। তার ছবি। ইথেন সমুদ্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শাড়ি সামান্য উঁচু করছে। তার সুন্দর ফরসা পা দেখা যাচ্ছিল। এখন অবিশ্যি দেখা যাচ্ছে না। বাবা কালো স্কচ টেপ দিয়ে পায়ের এই অংশ ঢেকে দিয়েছেন।
আমার অদ্ভুত লাগছে। আমি একজন মৃত মানুষের ঘরে বসে আছি। এখনো তার শরীরের গন্ধ ঘরে ভাসছে অথচ সে নেই। পাশের ঘর থেকে কোরান পাঠের আওয়াজ আসছে। মাঝে-মাঝে আসছে আগেরবাতির গন্ধ। এই গন্ধটা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই বাড়িতে মৃত্যু এসেছে।
কোথায় রেখেছে ইথেনকে? এই চিন্তাটা অস্পষ্টভাবে আমার মাথায় আসছে! চিন্তাটা দূর করতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ কেমন আমি জানি না। আরো অনেক বেওয়ারিশ লাশের সঙ্গে সে শুয়ে আছে? নাকি তাকে আলাদা রাখা হয়েছে? সে কি শুয়ে আছে ঠাণ্ডা মেঝেতে? নাকি টেবিলে রাখা হয়েছে? সকালবেলা ডাক্তাররা আসবেন। কাটাকুটি করবেন।
দরজায় টোকা পড়ছে। কেউ যেন খুব সাবধানে দরজা টানছে। আমি বললাম, কে?
দরজার ওপাশ থেকে চাপা গলায় কেউ একজন বলল, আপা আসব?
আমি এই গল চিনি। ইথেনের গলা। সামান্য ভাঙা ভাঙা। ঠাণ্ডা লাগলে ইথেনের গলা সামান্য ভেঙে যায়। আমি আবারো বললাম, কে?
দরজার ওপাশ থেকে ইথেন বলল, আপা তুমি যদি ভয় না পাও তা হলে আমি ঘরে আসব। আসি?
আমি জবাব দিলাম না। আমার মাথা কাজ করছে না। ইথেনের ঘরে বসে তার কথা ভাবছিলাম বলেই কি আমি প্রবল ঘোরের জগতে চলে গেছি? হেলুসিনেশন হতে শুরু করেছে? আমার এখন কী করা উচিত? বাবাকে ডাকা উচিত। নাকি আমি ইথেনকে ঘরে ঢুকতে বলব?
দরজায় ইথেনের হাত দেখা যাচ্ছে। চুড়ি পরা ফরসা হত। সবুজ কাচের চুড়ি। কত উঁচু থেকে সে পড়েছে। হাতের সব চুড়ি ভেঙে যাওয়ার কথা! অথচ এখনো হাত ভর্তি চুড়ি। সে দরজা আস্তে করে ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই তো ইথেনকে দেখা যাচ্ছে। তার বড় বড় চোখ ফরসা শান্ত চেহারা।
আপা তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
না।
ওরা আমাকে ঠাণ্ডা একটা বাক্সে ভরে রেখেছে। ভয় লাগছিল বলে চলে এসেছি। বেশিক্ষণ থাকব না। আপা বসব?
বোস।
বাতিটা নিভিয়ে দেবে? বাতির জন্য তাকাতে পারছি না। আলো চোখে লাগছে। আমি যন্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে বাতি নিবালাম। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হল না। বারান্দার বাতি জুলছে। তার আলো খোলা দরজা দিয়ে আসছে। সেই আলোয় ইথেনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হল সে কি আসলেই ইথেন? নাকি ইবলিশ শয়তান ইথেনের রূপ ধরে এসেছে? নাকি পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রবল ঘোর।
আপা বাবার সঙ্গে ঐ লোকটা কে?
ওনার পীর সাহেব।
তোকে একটা কথা বলতে এসেছি আপা! কথাটা বলে চলে যাব।
বল কী কথা?
তুই সাবধানে থাকিস। ইবলিশ শয়তান তোকে মারবে। সামান্য অসাবধান হলেই মারবে।
কীভাবে সাবধানে থাকব?
তাকে তুই ধাঁধার মধ্যে রাখবি। সে যেন তোকে পরিষ্কার কখনো বুঝতে না পারে।
কী রকম ধাঁধা?
তুই যে তার মতলব জানিস এটা তাকে বুঝতে দিবি না। আমার বুদ্ধি কম আমি তার কাছে ধরা খেয়ে গেছি। তোর বুদ্ধি বেশি তুই পারবি।
ইথেন আমার বুদ্ধি কিন্তু বেশি না।