ইথেন বলল, কেন মনে হচ্ছে না।
আমি বললাম, জিনের যেমন মিষ্টিপ্রীতির কথা শুনেছি তারা একটা সন্দেশ খাবে না। কয়েকটা খাবে। সন্দেশ খাবার পর তারা পানি খাবে না। এই জিন সন্দেশ খাবার পর পানি খেয়েছে। সন্দেশের থালার কাছে আধা খাওয়া পানির গ্লাস।
ইথেন মুখ কালো করে বাবার কাছে গেল। থমথমে গলায় বলল, বাবা রাতে তুমি সন্দেশ খেয়েছ?
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, একটা সন্দেশ খেয়েছি মা। হঠাৎ ক্ষুধা লাগল।
ইথেন কাঁদতে শুরু করল। বাবা বললেন, কাঁদার কী হয়েছে? বারোটা সন্দেশ তো তোর জিনের জন্য রাখা ছিল।
ইথেন সারা দিন কিছু খেল না। সেই রাতে দেখা গেল-বারোটা সন্দেশের একটাও নেই। কেউ এসে খেয়ে গিয়েছে।
তার পরের সপ্তাহেই আমি জিন বা শয়তান বা ইবলিশকে দেখলাম। তার সঙ্গে কথা বললাম। এই বিষয়টি আমি বিস্তারিত বর্ণনা করব।
শ্রাবণ মাস। বৃহস্পতিবার রাত। বৃষ্টি শুরু হয়েছে সন্ধ্যা থেকে। শ্রাবণ মাসের টিপটপ বৃষ্টি না। আষাঢ় মাসের ঝমোঝমা বৃষ্টি। ঝমোঝমা বৃষ্টি হলেই ইথেনের বৃষ্টিতে ভেজার শখ হয়। তার পাল্লায় পড়ে আমিও বৃষ্টিতে গোসল করেছি। পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। আমার ঠাণ্ডার ধাত। সামান্য ঠাণ্ডা লাগলেই টনসিল ফোলে। জ্বর এসে যায়। আমরা গোসল করছি। ছাদে। আমার ইচ্ছা খানিকক্ষণ ভিজেই উঠে পড়ব। ইথেন আমাকে ছাড়ল না। যতবার উঠতে যাই সে আমাকে জাপটে ধরে রাখে। প্রায় এক ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজলাম। আমার টনসিল ফুলে গেল। জ্বর এসে গেল। রাতে জ্বর বাড়ল। জ্বরের সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা। ইথেনের কাছে মাথাব্যথার ট্যাবলেট আছে। আমি দরজা খুললাম। ইথেনের কাছ থেকে ট্যাবলেট নেব এবং রাতে তার সঙ্গে ঘুমোব। অসুখবিসুখ হলে আমি একা ঘুমাতে পারি না।
বারান্দায় এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। শার্ট-প্যান্ট পরা এক লোক বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছে। বসে আছে ঠিক না খবরের কাগজ পড়ছে। লোকটার চোখে ভারী চশমা। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। শান্ত ভদ্র চেহারা। চেহারা দেখে মন হল তাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি।
রাত বাজে দুটা। এত রাতে কেউ গম্ভীর ভঙ্গিতে খবরের কাগজ পড়ে না। আমি বললাম, আপনি কে?
লোকটা খবরের কাগজ ভাঁজ করে পাশের চেয়ারে রাখতে–রাখতে বলল, আপনি ভালো আছেন? লোকটার গলার স্বর মিষ্টি! কথা বলার ভঙ্গিতে কোনো আড়ষ্টতা নেই। যেন আমি তার পূর্ব-পরিচিত। তাকে দেখাচ্ছিল পূর্ব-পরিচিতের মতোই। আমি আবারো বললাম, আপনি কে?
লোকটি বলল, বসুন তারপর বলছি।
আমি বললাম, আমি কি আপনাকে চিনি? আগে কখনো আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
লোকটি বলল, অবশ্যই দেখা হয়েছে। আমি ইবলিশ শয়তান। বলেই লোকটা হাসল। তখনি বুঝলাম আমি স্বপ্ন দেখছি। ইবলিশ শয়তান সেজেগুঁজে রাত দুটোর সময় আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়বে না। শুরুতে যে ভয়টা পেয়েছিলাম সেটা কেটে গেল। আমি বললাম, ইবলিশ শয়তান আপনি ভালো আছেন?
সে বলল, মিথু দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো।
আমি আবার চমকালাম। আমার নাম মিথেন। কিন্তু একজন মানুষ আমাকে মিথু ডাকত। যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম তখন আমার একজন প্রাইভেট মাস্টার ছিলেন! আমাকে অঙ্ক করাতেন। তার নাম রকিব। আমি যাকে ইবলিশ শয়তান ভাবছি। সে আসলে রকিব স্যার।
মিথু আমাকে চিনতে পারছ? আমরা শয়তানরা নানান রূপ ধরতে পারি। আমি তোমার অতি প্রিয় একজনের রূপ ধরে এসেছি।
আমি বললাম, রকিব স্যার কখনোই আমার অতি প্রিয় একজন ছিলেন না।
অবশ্যই ছিলেন। তোমার মনে নেই একদিন পড়াতে-পড়াতে তিনি হঠাৎ টেবিলের নিচে তোমার পায়ের উপর পা তুলে দিলেন। তুমি কিন্তু আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নাও নি। চুপ করেই সারাক্ষণ বসে ছিলে। রকিব স্যার সারাক্ষণ পা দিয়ে পা ঘষেছেন। হা হা হা।
আমি বললাম, আমি পা সরিয়ে নেই নি এটা ঠিক। সরিয়ে নেই নি কারণ আমি তাঁকে লজ্জা দিতে চাই নি। আপনি এত কিছু যখন জানেন তখন আপনার জানা থাকা উচিত যে সেই দিনই ছিল রকিব স্যারের কাছে আমার শেষ পড়া। আমি এরপর তাঁর কাছে আর পড়ি নি।
রেগে যাচ্ছ কেন মিথু?
আমাকে মিথু বলে ডাকবেন না।
আচ্ছা যাও ডাকব না। বসে গল্প করি।
আপনার সঙ্গে আমার গল্প করার কোনো ইচ্ছা নেই।
ইচ্ছা না থাকলেও তোমাকে গল্প শুনতে হবে। এখন আর তোমার আলাদা ইচ্ছা বলে কিছু নেই। আমার ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছ। বসতে বলছি বস।
আমি বসলাম। লোকটা বলল, কী নিয়ে গল্প করা যায় বলো তো? আমি জবাব দিলাম না! লোকটা আমার দিকে ঝুকে এসে বলল, জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে কিছুক্ষণ সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলি যেমন জিনের খাদ্য। তোমার বোনের ধারণা জিনরা মিষ্টি খায়। ধারণা ঠিক না। তারা মানুষ যে-অর্থে খাদ্য গ্ৰহণ করে সেই অর্থে খাদ্য গ্ৰহণ করে না। তোমরা মানুষরা মাছ-মাংস, কাৰ্বোহাইড্রেট, স্নেহ জাতীয় পদার্থ কত কিছু খাও। গাছ খায় শুধু পানি এবং সূর্যের আলো। কিছু কিছু ক্যাকটাস গোত্রের গাছ পানিও খায় না। সূর্যের আলোই তাদের জন্য যথেষ্ট! তোমরা মানুষরা যেমন একটা স্পেসিস, গাছও তেমন একটা স্পেসিস। একই পৃথিবীতে বাস করছ অথচ কী বিরাট পার্থক্য। জিন সম্পূর্ণ আলাদা একটা স্পেসিস। এই ব্যাপারটা তোমার বোনকে বুঝতে হবে। মানুষের মানদণ্ডে তাদের বিচার করা যাবে না।
আমি বললাম, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে নাকি আরো কিছু বলবেন?