ভূতপ্রেতের ছবিতে দেখা যায় এরা যখন হাঁটে দ্রুত হাঁটে। বাতাসের উপর দিয়ে ছুটে যায়। কিন্তু এই নগ্ন জিনিসটা পা টিপৌটিপে হাঁটছে। ছোট বাচ্চারা হাঁটা শিখলে যেভাবে হাটে তার হাঁটার ভঙ্গি সেরকম। টলমল করে ইটা! যেন তাকে না ধরলে সে এক্ষুনি ধপাস করে পড়ে যাবে। সে যখন আমার কাছাকাছি চলে এল তখন আমার মনে হল আমি করছি কী? আমি কেন দাঁড়িয়ে আছি? তখনই দৌড় দিলাম। পাগলের মতো সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম।
ইথেন বড় নিঃশ্বাস ফেলে থামল। আমি বললাম, ঐ নগ্ন জিনিসটা তোর পিছনে-পিছনে আসে নি?
ইথেন বলল, না।
আমি বললাম, তুই বাবাকে এই বিষয়ে কিছু বলেছিলি?
না।
বলিস নি কেন?
আমার ইচ্ছা হয় নি। দ্বিতীয়বার কী দেখলাম বলি?
আজ থাকি আরেকদিন শুনব।
ইথেন বলল, বলতে যখন শুরু করেছি আজই বলব। অন্য আরেকদিন হয়তো আমারই বলতে ইচ্ছা করবে না। সেদিনও ছিল বৃহস্পতিবার। বাবা গেছেন জিগির করতে। ঘরে আমরা দুইজন আর বাবার কলেজের পিয়ানটা। আমার পেট ব্যথা করছিল। বলে রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছি! অনেক রাতে খিদের জন্য ঘুম ভেঙে গেছে। ফ্রিজে খাবার আছে একটা কিছু খেয়ে নিলেই হয়। আবার মনে হচ্ছে এখন যদি খেতে যাই ঘুম পুরোপুরি ভেঙে যাবে। এপাশি-ওপাশ করে রাত কাটবে। তারচেয়ে চোখ বন্ধ করে। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। ঘুমিয়ে পড়লে ক্ষুধা টের পাব না। তখন শুনলাম ডাইনিং হলে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। কে যেন চেয়ার নাড়াচ্ছে। বেসিনে পানি ঢালার শব্দও হল। আমি উঠে বসলাম। বাতি জ্বালালাম। ঘর থেকে বের হলাম। ডাইনিং হল অন্ধকার। তবে সেখানে যে কেউ আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। আবার চেয়ার টানার শব্দ হল। আমি ডাইনিং হলের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরদা টানলাম। স্পষ্ট দেখলাম আমার দিকে পিছন ফিরে একজন কেউ বসে আছে। তার সামনে একটা প্লেট, প্লেট থেকে খাবার নিয়ে সে খাচ্ছে। আমি বললাম, কে? সে খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে ফিরল। মানুষের মুখের মতো একটা মুখ। শুধু তার চোখ দুটা পশুদের চোখের মতো। পশুদের চোখ যেমন অন্ধকারে জ্বলে তার চোখও অন্ধকারে জ্বলছে। সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার খেতে শুরু করল। যেন আমার উপস্থিতিতে তার কিছু যায় আসে না। আমি তোকে ডেকে তুললাম এবং বললাম আজ রাতে তোর সঙ্গে ঘুমাব। তোর মনে আছে না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
এটা কি মনে আছে। সারা রাত তোকে ঘুমাতে দেই নি। হাসাহসি করেছি। গল্পগুজব করেছি। তারপর দিলাম টিভি ছেড়ে। কী যেন একটা হিন্দি ছবিও দেখলাম।
মনে আছে।
পরদিন ভোরে ডাইনিং হলে গিয়ে দেখেছি প্লেট পড়ে আছে। প্লেটে আধা খাওয়া খাবার।
আমি বললাম, কী খাবার?
ইথেন বলল, সাধারণ ভাত-মাছ। ভাল।
আমি বললাম, জিন-ভূত কি ভাত-মাছ খায়?
ইথেন বলল, আমি তো জানি না। জিন-ভূত কী খায়। আমি জিন-ভূত না।
আমি বললাম, এমন কি হতে পারে না যে ভাত-মাছ-ডাল তুই নিজেই খেয়েছিস। তারপর ঘুমাতে গিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছিস।
ইথেন আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। তার মুখ দেখে মনে হল আমার কথা সে একেবারে যে অগ্রাহ্য করছে তা না। জিনের খাদ্য কী এই নিয়ে সব সময় তার মাথাব্যথা ছিল। জিন কী খায়, ভূত কী খায় এই নিয়ে বাবাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে। বাবা অসম্ভব বিরক্ত হতেন।
বাবা জিনের খাদ্য কী?
বাবা বললেন, জানি না মা।
তুমি এমন ধর্মকর্ম করা মানুষ। তুমি না জানলে কীভাবে হবে?
বাবা বললেন, আমি ধৰ্মকৰ্ম করলেও ধর্মের অনেক কিছু জানি না।
ইথেন বলল, যে জানে তার কাছ থেকে জেনে দাও। তোমার পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস কর।
বাবা বললেন, এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করতে ভালো লাগে নারে মা।
তুমি তো কারে সঙ্গে আলোচনা কর নি। তুমি বুঝবে কীভাবে আলোচনা করতে ভালো লাগে কি লাগে না?
মাগো বিরক্ত করিস না।
আমার প্রশ্নের জবাব বের না করে দিলে আমি বিরক্ত করেই যাব।
জিনের খাদ্য কী জেনে তুই কী করবি?
ওদের সব খাদ্য যোগাড় করে রাতের বেলা টেবিলে সাজিয়ে রাখব যাতে ওরা এসে খেতে পারে। জিনের খাদ্য নিয়ে আমি একটা বই লিখিব বলেও ঠিক করেছি। বইটার নাম হবে–জিনের সুষম খাদ্য। আরেকটা বই লিখব–জিনের খাদ্য ও পুষ্টি। এটা হবে রান্নার বই। সেখানে সব খাবারের রেসিপি দেওয়া থাকবে।
বাবা হতাশ গলায় বললেন, মারে তোর তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ইথেন গম্ভীর গলায় বলল, মাত্র শুরু আরো হবে।
আরো যে হবে। আমরা তার লক্ষণ দেখলাম। সে তার কোনো এক টিচারের কাছ থেকে খবর আনল জিনের পছন্দের খাবার মিষ্টি। মিষ্টির দোকানে তারা গভীর রাতে যায়। সব মিষ্টি খেয়ে দাম দিয়ে চলে যায়। যে কারণে গ্রামের অন্য সব দোকান সন্ধ্যার সময় বন্ধ হয়ে গেলেও মিষ্টির দোকানগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
ইথেন প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তেরোটা সন্দেশ একটা থালায় রাখে। তারের জালির ঢাকনা দিয়ে থালাটাকে ঢেকে রাখে যাতে বিড়াল এসে খেতে না পারে। সারা রাত সন্দেশের থালা থাকে। ডাইনিং টেবিলে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই ইথেন সন্দেশ গোনে। তেরোটা সন্দেশই আছে না। জিন এসে খেয়ে কমিয়েছে। তেরোটা সন্দেশের রহস্য হল ইথেনের লকি নাম্বার তেরো। তার জন্ম তারিখ অক্টোবরের তেরো।
সন্দেশ রাখার চতুর্থ দিন ভোরবেলায় হইচই শুরু হল। দেখা গেল সন্দেশ আছে বারোটা। একটা কম। জিন এসে একটা সন্দেশ খেয়ে গেছে। ইথেন আনন্দ এবং উত্তেজনায় লাফাচ্ছে! আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, জিন সন্দেশ খেয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।