- বইয়ের নামঃ কহেন কবি কালিদাস
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ দিব্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, দর্শন, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
সন্ধ্যা হয়-হয় করছে
কহেন কবি কালিদাস
পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ,
থাকলে কোথায় পেতে?
–লোকছড়া
০১.
সন্ধ্যা হয়-হয় করছে। এখনো হয় নি। আকাশ মেঘালা। ঘরের ভেতর অন্ধকার। সন্ধ্যা লগ্নে ঘর অন্ধকার থাকা অলক্ষণ। মিসির আলি লক্ষণ-অলক্ষণ বিচার করে চলেন না। চেয়ার ছেড়ে উঠতে তাঁর আলস্য লাগছে বলে। ঘরে বাতি জ্বালানো হয় নি। তিনি খানিকটা অস্বস্তির মধ্যেও আছেন। তার সামনে যে-তরুণী বসে আছে, অস্বস্তি তাকে নিয়েই। আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। এতক্ষণ সে বোরকার ভেতর থেকে কথা বলছিল, কিছুক্ষণ আগে মুখের সামনের পরদা তুলে দিয়েছে। মিসির আলি ধাক্কার মতো খেয়েছেন। এমন রূপবতী মেয়ে তিনি খুব বেশি দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না।
লম্বাটে মুখ। খাড়া নাক। লিপস্টিকের বিজ্ঞাপন হতে পারে এরকম পাতলা ঠোঁট! বড় বড় চোখ; চোখের পল্লব দীর্ঘ। তবে এই দীর্ঘ পল্লব নকলও হতে পারে। এখনকার মেয়েরা নকল পল্লব চোখে পরে। বরফি কাটা চিবুক। চিবুকে লাল তিল দেখা যাচ্ছে। এই তিলও মনে হয় নকল।
আমার নাম সায়রা। সায়রা বানু।
মিসির আলি মনে-মনে কয়েকবার বললেন–সায়রা, সায়রা। তীর ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। কেন তিনি মনে-মনে মেয়েটির নাম নিলেন তা বুঝতে পারলেন না। তিনি কি মেয়েটির নাম মনে রাখার চেষ্টা করছেন? এই কাজটি তিনি কেন করলেন? মেয়েটির অস্বাভাবিক রূপ দেখে? একটি কুরূপা মেয়ে যদি তার নাম বলত তিনি কি মনে-মনে তার নাম জপতেন?
সায়রা, তুমি কি রোজা রেখেছ?
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফতারের সময় হবে। আমার এখানে ইফতারের ব্যবস্থা নেই।
পানি তো আছে। এক প্লাস পানি নিশ্চয়ই দিতে পারবেন।
বলতে-বলতে মেয়েটি হাসল। রূপবতী মেয়েদের হাসি বেশিরভাগ সময়ই সুন্দর হয় না। দেখা যায়। তাদের দাঁত খারাপ। কিংবা হাসির সময় দাঁতের মাড়ি বের হয়ে আসে। দীত-মাড়ি ঠিক থাকলে হাসির শব্দ হয় কুৎসিত-হায়না। টাইপ। প্রকৃতি কাউকে সবকিছু দেয় না। কিন্তু সায়রা নামের মেয়েটিকে দিয়েছে। মেয়েটির হাসি সুন্দর। হাসি শেষ হবার পরেও মেয়েটির চোখ সেই হাসি ধরে রেখেছে। এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না।
মিসির আলি বিব্রত বোধ করছেন। মেয়েটি সারাদিন রোজা রেখেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান হবে। মেয়েটি রোজা ভাঙবে। ঘরে পানি ছাড়া কিছুই নেই।
আমি কি আপনাকে চাচা ডাকতে পারি?
পার।
চাচা, আমার ইফতার নিয়ে আপনি চিন্তিত হবেন না। আমার ইফতারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কীভাবে হবে?
আমি অনেকবার লক্ষ করেছি। রোজার সময় আমি যখন বাইরে থাকি তখন কেউনা-কেউ আমার জন্য ইফতার নিয়ে আসে। চিনি না জানি না। এমন কেউ।
যুক্তিহীন কথা বলেছ।
সায়রা হাসিমুখে বলল, আমি বিশ্বাসের কথা বলেছি, যুক্তির কথা বলি নি।
আমি বরং কিছু ইফতার কিনে নিয়ে আসি?
না, আপনি যেভাবে বসে আছেন বসে থাকুন। আপনার ঘরে কি জায়নামাজ আছে? আমি রোজা ভেঙেই নামাজ পড়ি।
জায়নামাজ নেই।
মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি এখন সামান্য দুলছে। যেচেয়ারে সে বসে আছে সেটা কাঠের একটা চেয়ার। রকিং-চেয়ার না। মেয়েটির দুলুনি দেখে মনে হচ্ছে সে রকিং-চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। কিশোরী মেয়েদের চেয়ারে বসে। দুলুনি মানানসই, এই মেয়েটির জন্য মানানসই না।
সায়রা!
জি।
তুমি কী জন্য আমার কাছে এসেছ সেটা এখনো বলো নি।
বলব। রোজা ভাঙার পর বলব।
আমি যদি সিগারেট ধরাই তোমার সমস্যা হবে?
জি না।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, সূৰ্য উদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত রোজা রাখার নিয়ম। তুমি যদি তুন্দ্ৰা অঞ্চলে যাও তখন রোজা রাখবে কীভাবে? সেখানে তো ছয় মাস দিন, ছয় মাস রাত।
সায়রা বলল, চাচা, আমি তো তুন্দ্রা অঞ্চলে যাই নি। যখন যাব তখন দেখা যাবে। আপনার কি চা খেতে ইচ্ছা করছে? আপনাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিই? যারা প্রচুর সিগারেট খায় তারা সিগারেটের সঙ্গে চা খেতে পছন্দ করে। এইজন্য বললাম। আপনি চা খেতে চাইলে আমি আপনার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসতে পারি।
মেয়েটি মিসির আলির অনুমতির জন্য অপেক্ষা করল না। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনার রান্নাঘর কোনদিকে?
মিসির আলি অতিদ্রুত কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে যে বিষয়টা তাকে সাহায্য করল তা হচ্ছে-মেয়েটি রান্নাঘরে গেল খালি পায়ে। স্যান্ডেল চেয়ারের পাশে পড়ে থাকল। তার অর্থ নিজ-বাড়িতে মেয়েটি খালি পায়ে হাঁটাহাটি করে। এই বাড়িতেও সে পুরোনো অভ্যাসবশত খালি পায়ে রান্নাঘরে গেছে। যে-বাড়িতে এই মেয়ে খালি পায়ে হাঁটে সে বাড়ির মেঝে হতে হবে ঝকঝকে ধূলিশূন্য। মার্বেলের মেঝে কিংবা পুরো বাড়িতে ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট।
মেয়েটি চেয়ারে বসে দোল খাওয়ার ভঙ্গি করছিল। অর্থাৎ মেয়েটির বাড়িতে একটি রকিৎ-চেয়ার আছে। সে অনেকখানি সময় এই চেয়ারে বসে কাটায়। সেই অভ্যাস রয়ে গেছে!
মেয়েটির নাকে নাকফুল আছে। নাকফুল হীরের। হীরের সাইজ ভালো। সচরাচর মেয়েরা নাকে যেসব হীরের নাকফুল পরে সেই হীরে চোখে দেখা যায় না। ম্যাগনিফাইং গ্লাসে দেখতে হয়।
মেয়েটি যখন উঠে রান্নাঘরে গেল তখন তার গা থেকে হালকা সেন্টের গন্ধ এসেছে। অতি দামি পারফিউম মাঝে মাঝে গন্ধ ছড়ায়। সব সময় ছড়ায় না। মেয়েটি অতি দামি কোনো পারফিউম মেখেছে।