আমি দুরদানার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়লাম। ঝুঁকে পড়লাম তার প্রেমে পড়েছি বলে নয়। তার মধ্যে প্রাণশক্তির সবল অঙ্কুরণ দেখে তার প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। লোকে তার নামে যা-তা বলে বেড়ায়, কারণ সে অন্য রকম। কেউ কখনো বলতে পারে নি সে পুরুষ মানুষের সঙ্গে ক্লাবে গিয়ে মদ খেয়ে কখনো মাতাল হয়েছে, টাকা নিয়ে কোনো ধনী ব্যক্তির অঙ্কশায়িনী হয়েছে, কিংবা প্রেমের ছলনা করে সাত-পাঁচটা পুরুষ মানুষকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে বেরিয়েছে। লোকে তার নিন্দে করত, কারণ সে ছিল একান্তভাবে সুস্থ এবং স্বাভাবিক। একদিন তার বাবা যখন বললেন, কলেজে আসা-যাওয়ার রিকশা ভাড়া দেয়ার ক্ষমতা তার নেই, তখন সে সাইকেল চালানো শিখে নিয়ে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল জোগাড় করে রিকশা ভাড়ার সমস্যার খুব একটা সহজ সমাধান করে নিল। একা একটা মেয়েকে সাইকেলে চলাচল করতে দেখলে সময়-অসময়ে বখাটে ছেলেরা তার ওপর চড়াও হতেও দ্বিধা করত না। এই রকম উৎপাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সম্প্রতি সে নিজের সঙ্গে একটা চাকু রাখতে আরম্ভ করেছে। সাইকেল চালাতে গিয়ে একদিন সে আবিষ্কার করল শাড়ি পরে সাইকেল চালাতে বেশ অসুবিধে হয়। সে শাড়ির পাট চুকিয়ে দিয়ে প্যান্ট-শার্ট পরতে আরম্ভ করল।
তার ভাই চরমপন্থী রাজনীতি করত। রাজরোষ তার মাথার ওপর উদ্যত খড়গের মতো ঝুলছিল। সরকার তার মাথার ওপর চড়া দাম ধার্য করেছে। এমন ভায়ের বোন হিসেবে তার লুকিয়েচুপিয়ে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুরদানা সে অবস্থাটা মেনে নেয় নি। ভাইয়ের বিপ্লবী রাজনীতি সম্বন্ধে তার অপরিসীম গর্ববোধ ছিল। তাই সবসময় সে মাথা উঁচু করে বেড়াতো। আমাদের সমাজে এই এতখানি স্বাভাবিকতা সহ্য করার খুব বেশি মানুষ ছিল না। কেউ কেউ তাকে পথেঘাটে আক্রমণ করত। যারা তার ওপর হামলা করত দুরদানা তাদের কোনো ক্ষতি করে নি। যারা তার নামে নানা রকম অশ্লীল গল্প রটিয়ে বেড়াতো, তাদের যৌন-যন্ত্রটা আসল জায়গার বদলে মগজের গভীর প্রদেশে অবস্থান করত বলে এমন সুন্দর কাহিনী তারা অনায়াসে রচনা করতে পারত।
দুরদানা আমার ঘরে এসেছে, দারোয়ান হোস্টেলে ঢুকতে বাধা দিয়েছে, সে পকেট থেকে ধারালো চাকু বের করে দারোয়ানের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিতে গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দারোয়ান একজোট হয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে বিচার দাবি করেছে এবং ভাইস চ্যান্সেলর আমাকে ডেকে কড়া কৈফিয়ত তলব করেছে, এইসব খবর গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোমা ফাটানোর মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমি খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আর্ট ইনস্টিটিউটে দুরদানা নামে এক ডাকাবুকো মহিলা আছে এবং সে সব ধরনের অকাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে ওস্তাদ, একথা আমি ছাড়া সবাই জানে। ঘটনাটি মওলানা হান্নানকে কি রকম বিচলিত করে তুলেছিল তার উল্লেখ করছি। অবশ্য তার আগে মওলানা হান্নানের বিষয়ে একটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন। হান্নান সম্প্রতি ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারারের চাকরি পেয়েছে। সে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ক্লাস করতে আসত এবং দাড়ি রাখার একটা নতুন স্টাইল সৃষ্টি করেছিল। কানের নিচে থেকে শুরু করে থুতনি হয়ে কানের অপর অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো দাড়িতে তাকে ভাল কি খারাপ দেখাতো, সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু চোখে পড়ত।
রোদ বৃষ্টি থাকুক-বা-না-থাকুক সময় সময় ছোট ছাতাটা মাথার ওপর মেলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। সে সময় গোল টুপিটা মাথার বদলে শোভা পেত হাতে। তার সম্পর্কে আরেকটি মজার সংবাদ হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পর পাজামা-পাঞ্জাবি বদলে শার্ট-প্যান্ট পরত। আমরা তাকে নিয়ে নানারকম মজা করতাম। আমাদের ঠাট্টা-তামাশা সে গায়ে মাখত না। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, মওলানা তুমি এরকম করে দাড়ি ঘেঁটেছ কেন? হান্নান গম্ভীর হয়ে জবাব দিত, চাঁদ হলো ইসলামের চিহ্ন। তাই আমার দাড়ি আমি আলহেলালের মতো করে রেখেছি। মওলানা হান্নানের এরকম অনেক ব্যাপার ছিল, যেগুলো চট করে চোখে পড়ে যেত।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বুড়ি বুড়ি শিক্ষিকাদের রুমে রুমে গিয়ে গল্প করতে সে খুব পছন্দ করত। সেদিকে ইঙ্গিত করে কোনো কিছু বললে, পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দিত, না না, বেআইনি কিছু নয়। গুলশান আপার সঙ্গে আমি ধর্ম এবং দর্শনের কিছু সমস্যার কথা আলোচনা করে আনন্দ পেয়ে থাকি। তার মুখে একটা লজ্জার ছোঁয়া লাগত। সেটা চাপা দেয়ার জন্যে ‘গুলশান আপার ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে কত অগাধ জ্ঞান’ বলে একটা নাতিদীর্ঘ লেকচার দিয়ে বসত।
হান্নান এক শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের সামনে আমাকে আটক করে বসল। সে জুমার নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বেরিয়েছে। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলাম। হান্নান আমার কলার ধরে হিড়হিড় করে ছাতিম গাছের গোড়ায় টেনে নিয়ে গেল। আমি আশঙ্কা করছিলাম, হান্নান শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ার ফজিলত সম্পর্কে কিছু হেদায়েত করবে। আমিও একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। সে আজ পাঞ্জাবির ওপর আচকান চাপিয়েছে, চোখে সুরমা, কানে আতর মাখানো তুলো গোঁজা। সব মিলিয়ে একটা পবিত্র-পবিত্র ভাব। এই বিশেষ সাজ-পোশাকে আমার সঙ্গে যদি গুলশান আপার সঙ্গে যেমন করে, সেরকমভাবে ধর্মতত্ত্বের আলোচনা শুরু করে, আমি বেকায়দায় পড়ে যাব। তাই তাড়াতাড়ি কাট মারার জন্যে বললাম, হান্নান, কি বলবার আছে তাড়াতাড়ি বলো, খিদেয় প্রাণ বেরিয়ে আসছে। হান্নান আমার কথা গ্রাহ্যই করল না। জামার কলারটা ভাল করে চেপে ধরে বলল, জাহিদ তোমার কাজটা বেআইনি হচ্ছে। আমি বললাম, বেআইনী কাজ তো তুমিই করো। গুলশান আপার মতো মডার্ন মহিলার সঙ্গে ধর্মতত্ত্বের আলোচনা করাটা হলো দুনিয়ার সবচাইতে বেআইনি কাজ। হান্নান আমার কথা মোটেই আমল না দিয়ে মুখ গম্ভীর করে বলল, আমি জানি তুমি দুরদানা বেগমের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসছ। আমি বললাম, আড্ডা দিয়ে আসছি ভাল করেছি, তুমি জানলে কি করে? সে বলল, শাহবাগ থেকে আসার সময় তোমাদের দুজনকে দেখেছি। আমি বললাম, দেখেছ বেশ করেছ। মওলানা তুমি মিছেমিছি নামাজ পড়লে । আল্লাহ তোমার জুমার নামাজ কবুল করবে না। তুমি নামাজ পড়তে পড়তে কোন্ ছেলে কোন্ মেয়ের সঙ্গে কি করল এসব চিন্তা করেছ। কলার ছাড়, আমি যাই।