এই সময় পত্র-পত্রিকায় শাহরিয়ারের কবিতা ক্রমাগত প্রকাশিত হচ্ছিল। এগুলো পড়ে আমি একা শুধু মুগ্ধ বোধ করছিনে, যারাই পড়ছে অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। একজন রুগ্ণ তরুণ তার জীবনী-শক্তির উত্তাপ দিয়ে এমন সুন্দর প্রাণবন্ত কবিতা কেমন করে লিখতে পারে! এমন প্রাণশক্তিতে ভরপুর কবিতা শাহরিয়ার লিখছে, কবিতায় শরীরের রোগ কিংবা যন্ত্রণার সামান্য স্পর্শও নেই। এমন আশ্চর্য স্নিগ্ধ প্রশান্তি শাহরিয়ারের এল কেমন করে? শামারোখের ভালোবাসাই কি শাহরিয়ারের কল্পনাকে স্বর্গ সৃষ্টিতে পারঙ্গম করে তোলে নি? আমি নিজেকে ঘৃণা করতে থাকলাম। শামায়োখের সঙ্গে আমারওতো একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। আমি শাহরিয়ারের মতো এমন প্রাণস্পন্দনময়, এমন প্রশান্ত একটি পঙক্তিও তো রচনা করতে পারি নি? প্রজাপতি যেমন ফুল থেকে বিষ আহরণ করে, আমারও কি তেমনি খারাপ দিকটির প্রতি প্রথম দৃষ্টি পড়ে? আমি শামারোখের ভেতরের ওই বিস্ময়কর অংশটি আবিষ্কার করতে পারি নি কেন? শুধু খালি চোখে যতদূর দেখি তার বাইরে দেখার ক্ষমতা কি আমার একেবারে নেই?
আমার মনে জ্বালা ধরে গিয়েছিল। তবু শাহরিয়ার এবং শামায়োখের অকুণ্ঠ প্রশংসা না করে পারলাম না। মাহফুজের কাছে আমি জেনেছি, শাহরিয়ারের একটি পা কবরের ভেতর। তার পরেও প্রেমের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে মৃত্যুর শীতল স্পর্শকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে শাহরিয়ার। তার ওই কবিতাগুলো তো মৃত্যুর বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। হয়তো শাহরিয়ার বেশিদিন বাঁচবে না। কিন্তু বেশিদিন বেঁচে কি লাভ? জীবন-মরণের যা অভীষ্ট, শাহরিয়ার তো তার সন্ধান পেয়ে গেছে। শাহরিয়ারের কাছে আমার নিজেকে বিবমিষা উৎপাদনকারী তুচ্ছ কৃমিকীট বলে মনে হতে থাকল।
তার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিরও একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। শামারোখের শারীরিক সৌন্দর্য প্রথমদিকে পূর্ণিমার চাঁদ যেমন সমুদ্রের জলকে আকর্ষণ করে সেভাবে আমাকে আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে মেলামেশার এক পর্যায়ে তার সৌন্দর্যের প্রতি আমি পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। শেষের দিকে ভয় করতে আরম্ভ করেছিলাম। তার শরীর দেখলে আমার রং-করা মাংস বলে মনে হতো। এই সৌন্দর্যের ফঁসে যাতে আমি আটকে না যাই, পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করতাম। এখন অনুভব করতে পারছি শামায়রাখের অপরূপ সৌন্দর্য হলো ঈশ্বরের এক মহান দান। এই সৌন্দর্য কী অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে সক্ষম, শাহরিয়ারের কবিতাগুলো পড়েই বুঝতে পারছি। আমি ধরে নিলাম আমার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে গেছে। এক সময় ইচ্ছে করলে আমি শামায়োখকে সম্পূর্ণ আপনার করে নিতে পারতাম। তার প্রকৃত রূপ অন্তরের চোখ দিয়ে অবলোকন করতে পারতাম। আমি একজন পাষণ্ড, আমার হৃদয়ে চোখ জন্মাবে কেমন করে । ঈশ্বরের মহত্তম দান আমি অবহেলা করেছি বলে, দাম দেবার কেউ থাকবে না, সেটা কেমন করে হতে পারে? ঈশ্বরের রাজত্বে এত অবিচার কি সম্ভব?
শামারোখ শেষ পর্যন্ত সেই মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে গেছে, যে তাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে। হোক না তা অত্যন্ত ক্ষণিকের। আমার অনুভব করতে বাকি রইল না আমি নিতান্তই একজন হতভাগা। মানুষ হিসেবে আমার অপূর্ণতাই আমাকে পীড়িত করছিল। এখন আয়নায় নিজের মুখ দেখতে আমার কষ্ট হয়।
.
২০.
একদিন রাতে ঘুমিয়ে আছি। মাহফুজ এসে আমার ঘুম ভাঙালো। ঘড়িতে দেখি। একটা বেজে গেছে। আমি মাহফুজের দিকে একটু বিরক্তির দৃষ্টিতেই তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বিত্তান্ত, এত রাতে? মাহফুজ বললেন, আপনাকে একটু আসতে হয়। আমি বললাম, কোথায়? মাহফুজ বললেন, হাসপাতালে। আমি বললাম, হাসপাতালে কেন? তিনি বললেন, পরশুদিন শাহরিয়ারকে ভর্তি করানো হয়েছে, ছটফট করছে। ডাক্তার বলছেন, আর বেশি দেরি নেই। আপনাকে দেখতে চাইছে। জাহিদ সাহেব আপনি যেদিন আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন আমি তো বলেছিলাম এই ডাকিনী মহিলা শাহরিয়ারকে চারটি মাসও বেঁচে থাকতে দেবে না। এখন মাত্র তিনমাস। দেখছেন তো আমার কথাটা এখন সত্যি হতে যাচ্ছে। আমি মাহফুজের কথার কোনো জবাব দিলাম না। মনে মনে বললাম, শাহরিয়ার না বাঁচলেও এমন কি ক্ষতি! সে তো অমৃতের সন্ধান পেয়ে গেছে।
আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি অনেক মানুষ তার বিছানার চারপাশে। ছোট্ট কক্ষের মধ্যে স্থান সংকুলান হচ্ছে না দেখে অনেকে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার শেষ অবস্থা নিশ্চিত জেনে মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটি খুলে নিয়েছেন। শাহরিয়ারের পাশের একটি খাটে শামারোখ মুখে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাকে একটি ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছে। আমি যখন গিয়ে শামারোখের কপালে হাত রাখলাম, দেখি তার চোখের কোণ দুটো পানিতে ভরে গেছে। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে। বিড় বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করছে। আমার কান একেবারে তার মুখের কাছে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কি বলছে কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। তারপরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ। শাহরিয়ারের বোনটি ডুকরে কেঁদে উঠে দুহাত দিয়ে নিপ্রাণ শরীরটাকে আঁকড়ে ধরল।
শামারোখের কোনো ভাবান্তর নেই। গালের ওপর হাতটা রেখে শাহরিয়ারের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। আমার কেন জানি মনে হলো, সে আমাকে বলছে, ওহে পাষণ্ড, তুমি চেয়ে দেখো একজন তরুণ আমার সৌন্দর্যের বেদিমূলে এইমাত্র তার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করল।