.
০৪.
সেদিনই সন্ধ্যেবেলা হোস্টেলে এসে একটা চিরকুট পেলাম। পাঠিয়েছেন মাহমুদ কবির সাহেব। তিনি বয়সে প্রবীণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের একজন। আমাদের মতো তরুণদের সঙ্গে মেলামেশা করেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বদনাম। অনেক বুড়ো বুড়ো শিক্ষকদের বলতে শুনেছি ড. মাহমুদ কবির চ্যাঙড়া পোলাপানদের আশকারা দিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, প্রবীণ শিক্ষকদের মান-ইজ্জত নিয়ে চলাফেরা করা একরকম দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা পাঁচ-সাত বছর ধরে মাহমুদ সাহেবের বাড়িতে আসা-যাওয়া করছি। তার কখনো চিরকুট পাঠিয়ে কাউকে বাড়িতে ডাকতে হয়েছে, এমন সংবাদ আমার জানা নেই। আমি একটুখানি চিন্তিত হলাম। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি ব্যাপার। জামা কাপড় ছেড়ে গোসল করে ফেললাম। গোসল করার পর বেশ ঝরঝরে বোধ করতে থাকি। তখুনি পেটের খিদেটা টের পেলাম। ড. মাহমুদ সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নেয়া প্রয়োজন। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখলাম, চা ছাড়া খাওয়ার মতো কিছু নেই। অগত্যা শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে যেতে হলো। একটা একটা করে চারটে সিঙারা খেয়ে ফেললাম। চায়ে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় দেখতে পেলাম হুমায়ুন কোণার দিকের টেবিলটাতে বসে ঘুসুর-ঘুসুর করে মজিদ মামার সঙ্গে কথা বলছে। মজিদ মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন। কখনো ছাত্র ছিলেন কি না, তাও আমার জানা নেই। সব সময় একখানা সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। পাজামার সঙ্গে তিন দিকে পকেটঅলা হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত একটা নকশা আঁকা শার্ট পরেন। সবসময়ে ওই পোশাকেই তাকে দেখে আসছি। তিনি শার্টের গভীর পকেট থেকে পানের ছোট ছোট বানানো খিলি বের করে মুখের ভেতরে পুরে নেন। তার পান খাওয়ার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। ঠোঁট ফাঁক না করেই তিনি পানটা চিবিয়ে কিভাবে হজম করে ফেলেন, সেটা আমার কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। অতিরিক্ত পান খাওয়ার জন্যে তার বড় বড় দাঁতগুলো গ্যাটগেটে লাল দেখাতো। প্রথম যেদিন মজিদ মামার সঙ্গে হুমায়ুন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার লাল লাল দাঁতগুলোই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আমি ভীষণ রকম অস্বস্তি বোধ করেছিলাম। মজিদ মামা কোথায় থাকেন, কি করেন এবং হুমায়ুনের কি ধরনের মামা, এসব কিছুই জানতাম না। হুমায়ুন মামা ডাকত, আমরাও মামা ডাকতাম। দিনে দিনে মজিদ আমাদের অনেকেরই কমন মামা হিশেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
আমি বিল পরিশোধ করে বাইরে এসে দেখি, আমার পেছন পেছন হুমায়ুন এবং মজিদ মামাও বাইরে চলে এসেছেন। হুমায়ুন আমাকে জিজ্ঞেস করল, জাহিদ ভাই কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম, যাচ্ছি এক জায়গায়। একটু বসবেন? আমি বললাম, না, আমার কাজ আছে। আমি দেখলাম হুমায়ুন মজিদ মামার সাইকেলের পেছনে বসে শাহবাগের দিকে কোথায় চলে গেল। নীলক্ষেতের অপরূপ সন্ধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কেশবতী সন্ধ্যে আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল, মনে হচ্ছিল, আমি শান্তি সরোবরের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করছি। কলাভবনের চারপাশে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়ালাম। কঁকড়া ঝাকড়া আবছা অন্ধকারে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পত্রপল্লবের মধ্যে বিধাতার আশীর্বাদের মতো শান্তি স্থায়ী নীড় রচনা করে আছে। গুরু দুয়ারার ভেতর থেকে শিখ পুরোহিতের কণ্ঠের ভজনের ধ্বনি ভেসে আসছে। প্রার্থনার ভাষা এত সুন্দর! আপনা থেকেই আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। আমি গুরু দুয়ারার পেছনে শিশু গাছটির গোড়ায় বসে পড়লাম এবং অনেকক্ষণ ধরে ভজন শুনলাম। ভজন থেমে যাওয়ার পরও সেই স্তব্ধতার মধ্যে চুপ করে বসে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল অতল স্তব্ধতার ভেতর থেকে জাগ্রত প্রার্থনার ভাষা ছাড়া জীবনের জন্য অন্য কোনো সত্য বস্তু নেই।
এক সময়ে আমাকে উঠতে হলো। ড. মাহমুদ কবিরের বাড়ির দরজার বেল টিপলাম। তার সব সময় মুখ হাঁ-করে-থাকা কাজের লোকটা বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দিল। সামনের দরজাটা বরাবরের মতো আজো তালা আটকানো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর থেকেই সামনের দরজায় তালা আটকানোর রেওয়াজ চালু হয়েছে। সামনের দরজার তালা আটকানো মানে কেউ বাড়িতে নেই। এখন বাড়িতে সবাই থাকলেও সামনের দরজার তালা বিদেয় নেয় নি। তার মানে বাড়ির মানুষদের মানসিক ভীতি এবং অনিশ্চয়তার অবসান হয় নি। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম ড. মাহমুদের বাড়িতে অনেক মানুষ। তিনি আজ বিকেলবেলা দাড়ি কাটেন নি। তার ফরসা মুখমণ্ডলে রসুনের শেকড়ের মতো অজস্র দাড়ি অঙ্কুর মেলেছে। তিনি গড়গড়া টানছিলেন। সবাই মিলে কি নিয়ে আলোচনা করছিলেন বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখামাত্রই ড. মাহমুদ কবির উত্তেজনার তোড়ে একরকম উঠে দাঁড়ালেন। গড়গড়ার নলটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। কোনোরকম ভূমিকা না করেই তিনি বললেন, তোমার সাহস তো কম নয় হে ছোকরা! তিনি কোথায় কেমন করে আমার সাহসের পরিচয় পেলেন, বুঝতে পারলাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আমার অপরাধ কি? আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কারণ বসবার জায়গাগুলো অন্য সবাই আগে থেকেই দখল করে আছেন। কেউ আমাকে বসবার জায়গা করে দিলেন না। তিনি গড়গড়ার নলটা কুড়িয়ে নিয়ে টান দিয়ে দেখেন তামাক পুড়ে শেষ। কড়া স্বরে আকবর বলে ডাক দিলেন। সেই মুখ হাঁ-করা মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালে কল্কিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তামাক লাগাও। ড. মাহমুদ যেভাবে তামাক এবং চা দেয়ার জন্য হুংকার ছেড়ে কাজের মানুষটিকে ডাক দিয়ে বীরত্ব প্রকাশ করেন, তার সঙ্গে সেনা প্যারেডের কমান্ডিং অফিসারের অনায়াসে তুলনা করা যায়। আকবর ফুঁ দিতে দিতে কল্কিটা হুঁকোর ওপর বসিয়ে দিতেই তিনি লম্বা করে ধোঁয়া ছড়ালেন, তারপর বললেন, সবাই বলছে তুমি ইউনুস জোয়ারদারের ডাকু বোনটির সঙ্গে যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছ। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের ওয়ার্ডেন আজ সকালবেলা মর্নিং ওয়াকের সময় আমাকে বলেছেন তুমি দুরদানা না ফুরদানা সেই গুণ্ডা মেয়েটিকে নিয়ে দারোয়ানকে ছুরি মারার ভয় দেখিয়েছ। ওয়ার্ডেন মতিন তোমাকে সতর্ক করার জন্য ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তুমি উল্টো তাকে হুমকি দিয়েছ। ব্যাপারটা ভাইস চ্যান্সেলরের কান পর্যন্ত এসেছে। তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত। ওই গুণ্ডা মেয়েকে নিয়ে ঘোরাফেরা করলে তুমি তো বিপদে পড়বেই এবং যাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে, তাদের সবাইকেও বিপদে ফেলবে। ওই মেয়ের ভাই ইউনুস জোয়ারদার একজন সন্ত্রাসী, খুনি। সে সব জায়গায় মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে। বোনটাও ভাইয়ের মতো সাংঘাতিক। শুনেছি সবসময় সে ছুরি-পিস্তল সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তুমি নিরীহ মানুষের সন্তান, তুমি কেন ওসবের মধ্যে নিজেকে জড়াবে! মুজিব সরকার ইউনুসকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে, জানো!