এই সময়ের মধ্যে একদিন এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে আমার সঙ্গে শাহরিয়ার এবং শামারোখের দেখা হয়ে গেল । শাহরিয়ার চমৎকার একটি আকাশী নীল উলের জ্যাকেট পড়েছে। মাফলারটা গলার চারপাশে জড়ানো। তার সারা শরীর থেকে তারুণ্য ঝরে ঝরে পড়ছে। এই অবস্থায় দেখে কারো মনে হওয়ার উপায় নেই, শাহরিয়ারের শরীরে কোনোরকম রোগব্যাধি আছে। আগের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে শাহরিয়ারকে। শামারোখ পরেছিল মেরুন রঙের শাড়ি। শাহরিয়ারের পাশে শামায়োখকে এত অপূর্ব দেখাচ্ছিল, অনেকক্ষণ আমি দুজনের ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি নি।
আসর ভেঙে যাওয়ার পর শামারোখ আমাকে নেহায়েত ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করেছিল, গান কেমন শুনলেন? নেহায়েত একটা জবাব দিতে হয়, তাই বলেছিলাম, ভাল। শাহরিয়ার আমার দিকে একজন অপরিচিতের দৃষ্টি দিয়ে তাকালো এবং জিজ্ঞেস করল, জাহিদ সাহেব নাকি? কেমন আছেন, আপনি এখন কোথায় থাকেন? শাহরিয়ারের এই ধরনের সম্ভাষণ শুনে আমি মনের মধ্যে একটা আঘাত পেয়ে গেলাম। সে ঢাকা আসার পর থেকেই আমাকে জাহিদ ভাই ডেকে আসছে। বুঝতে পারলাম, শামারোখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে আমার অস্তিত্বটাই তার পক্ষে অসহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে শামারোখের এতদিনের মেলামেশা সম্পর্কে সে জানতে পেরেছে। নানা মানুষের কাছ থেকে আমি নানা সংবাদ পাচ্ছিলাম। একজন বলল, শামারোখকে শাহরিয়ারের সঙ্গে শেরাটন হোটেলে দেখা গেছে। আরেকজন বলল, এক শুক্রবার শামারোখ এবং শাহরিয়ার চিড়িয়াখানার বানরদের বাদাম খাইয়েছে। আবার কেউ এসে বলল, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে দুজনকে পরস্পর হাত ধরাধরি করে ঘুরতে দেখা গেছে। এই সমস্ত খবরে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু যারা এসে খবরগুলো বলছে তাদের বিকৃত আনন্দ উপভোগের পদ্ধতিটি দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। এতকাল তারা শামারোখের সঙ্গে আমাকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। অনেকেই জানে শামারোধের জন্য আমি একটা লড়াই করেছি। এখন শামারোখ আমাকে ছেড়ে শাহরিয়ারের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছে, ওই সংবাদটা আমাকে জানানোর উদ্দেশ্য হলো অনেকটা এরকম: এতদিন তো এই মহিলাকে নিয়ে আকাশে উড়ছিলে, আশপাশের মানুষকে মানুষ মনে কর নি। এখন মহিলা তোমাকে ল্যাং মেরে অন্য মানুষের সঙ্গে ঘুরছে, এখন বোঝো মজাটা! শামারোখকে আমি একরকম চিনে ফেলেছি। তার কোনো ব্যাপারেই আমার উৎসাহ নেই। সে যা ইচ্ছে করুক। কিন্তু শুনে কষ্ট লাগল শাহরিয়ার নানা লোকের কাছে নানা জায়গায় আমার নামে নিন্দেমন্দ বলে বেড়াচ্ছে। শাহরিয়ার আমার নামে যা ইচ্ছে বলে বেড়াক। আমি হিসেব করে দেখেছি, এটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমার বুঝতে বাকি রইল না, আমাকে একটা শিক্ষা দেয়ার জন্যই মহিলা শাহরিয়ারকে বেছে নিয়েছে। শাহরিয়ার যা বলবে আমি প্রতিবাদ করতে পারব না। লোকে মনে করবে আমার ঈর্ষার ভাব জন্মেছে বলেই আমি শাহরিয়ারের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেমেছি। শাহরিয়ার পথেঘাটে যেসব বলে বেড়াচ্ছে এর কোনোটাই তার কথা নয়। শামারোখ যা বলাচ্ছে, সে তাই বলে যাচ্ছে।
একজন তরুণ কবি রসিকতা করে বলেছিলেন ঢাকা শহরের কাকের সংখ্যা যত, কবির সংখ্যা তার চাইতে কম হবে না। কথাটার মধ্যে একটা শ্লেষ আছে । তারপরেও আমার মনে হয়, একটা বিষয়ে কবিদের সঙ্গে কাকদের মিল আছে। একটা কাক যখন বিদ্যুতের তারে আটকে যায়, কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়ে, রাজ্যের কাক ছুটে এসে সাহায্য করতে পারুক না পারুক সমবেদনা প্রকাশ করে। কাকদের যেমন সমাজবোধ প্রবল, কবিদের সমাজবোধ তার চাইতে কম নয়। একজন কবির ভাল-মন্দ কিছু যখন ঘটে অন্য কবিরা সেটা খুব সহজে জেনে যায়। তারা বিষয়টা নিয়ে এমন জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে, সেটা সকলের চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। একজন কবি যখন বিয়ে করে, প্রেমে পড়ে, কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসে, কিংবা যৌন রোগের শিকার হয়, সেটা খুব সহজেই সবার আলোচনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কবিদের সঙ্গে কাকদের প্রজাতিগত সহমর্মিতার ব্যাপার ছাড়া আরো একটি বিষয়ে মিল আছে। একটি কাক আরেকটি কাকের মুখের খাবার কেড়ে নেয়ার জন্য যতরকম ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে থাকে, একজন কবি আরেকজন কবির প্রাপ্য সম্মানটুকু কেড়ে নেয়ার জন্য তার চাইতে কিছু কম করে না।
কবি এবং কাকের চরিতমানস যে বিশ্লেষণ করতে হলো তার একটা বিশেষ কারণ আছে। শাহরিয়ার এবং শামারোখের সম্পর্ক নিয়ে প্রায় প্রতিদিন এত কথা আমাকে শুনতে হতো যে, মেজাজ ঠিক রাখা একরকম দায় হয়ে দাঁড়ালো। আমি বুঝতে পারি নে শামারোখ এবং শাহরিয়ারের সমস্ত সংবাদ আমার কাছে বয়ে নিয়ে আসা হয় কেন? আমাকে নিছক মানসিক কষ্ট দেয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, এমনতো মনে হয় না। শামায়োখ যখন আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো, তখনো কি আমাদের নিয়ে মানুষ এত কথা বলত? হয়তো বলত, আমি জানতাম না। নিজের ভেতর এতটা বিভোর হয়েছিলাম যে, কোনদিকে কি ঘটছে, কোথায় মানুষ কি বলছে, তাকাবার অবকাশ ছিল না।
তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস আমি নিজেও স্বীকার করব। শামায়োখ-শাহরিয়ারের সম্পর্ক এমন একটা নতুন মাত্রা অর্জন করেছে, মানুষ সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে পারছে না। তার প্রথম কারণ শাহরিয়ার এই সবে মৃত্যুর কবল থেকে কোনোরকমে ফিরে আসতে পেরেছে। সে যে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছে, এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত কিছু বলতে পারে না। শামায়োখের মতো এমন অপরূপ বিদুষী একজন মহিলা, যার পরমায়ু নিশ্চিত নয় এমন একজন তরুণ কবির পেছনে ছায়ার মতো লেগে আছে, এই ঘটনাটিকে মানুষ অস্বীকার করবে কেমন করে? কুকুর মানুষ কামড়ালে সংবাদ হয় না, মানুষ যখন কুকুরকে কামড়ায় সেটাই সংবাদের বিষয়বস্তু হওয়ার মর্যাদা অর্জন করে। একজন চালচুলোহীন তরুণ কবি, কদিন বেঁচে থাকবে যে জানে না তার পেছনে সমাজে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত একজন সুন্দরী নারী হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা এমন করে উজাড় করে দিচ্ছে, সে জিনিসটি নিয়ে মানুষ যদি মাথা না ঘামায়, তাহলে মানুষ সম্পর্কে খুব ছোট করে ভাবতে হয়। শাহরিয়ার এবং শামারোখের সম্পর্কের ধরনটাই একটা বিশেষ শিল্পকর্মের মতো মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এই সম্পর্কের কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা নেই, সবটাই বর্তমান। যে ফুল ফোঁটার পর একরাতের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়, তার সৌন্দর্যের মতো, গন্ধের মতো শামায়োখ-শাহরিয়ারের সম্পর্ক।