শাহরিয়ারের প্রতি আমার নালিশ নেই, কিন্তু দুঃখ আছে। দুঃখ এই কারণে যে দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো সে এই বেশ্যাদের কাছ থেকেই পেয়েছে। অপরিমিত মদ্যপান, অনাহার, অনিয়ম এবং বেশ্যা সঙ্গের কারণে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছিল, এখানকার ডাক্তারেরা বলে দিয়েছিলেন, এ দেশে তার চিকিৎসা নেই। বাইরেটাইরে কোথাও চেষ্টা করলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়তো অসম্ভব নাও হতে পারে। অনেকে শাহরিয়ারের অসুখের কথা জানত, অনেকেই তার কবিতা ভালোবাসতো। বিনা চিকিৎসায় শাহরিয়ারের মতো একজন সম্ভাবনাময় কবি মারা যাবে, এটা কেউ মেনে নিতে পারে নি। শাহরিয়ারকে মার্কিন দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর একটা জোর দাবি উঠেছিল। সরকারকে সে দাবি মেনেও নিতে হয়েছে । পুরিসির চিকিৎসার জন্য সরকার তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পাঠিয়েছিল। আমি এতদূর পর্যন্ত শাহরিয়ারের খবর রাখতাম। চিকিৎসা শেষ করে দেশে এসেছে, এই সংবাদ আমি পত্রিকায় পড়েছিলাম। তারপরেইতো পড়লাম, কবিতা। শাহরিয়ারের খবর জানার জন্য আমার মনটা আকুল হয়ে উঠল। আমি মোহাম্মদপুরে মাহফুজের বড়িতে গেলাম। কারণ একমাত্র মাহফুজই গত আট-দশ বছর ধরে শাহরিয়ারকে বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে আসছে। বিদেশে পাঠানোর বেলায়ও মাহফুজ যত খাটাখাটনি করেছে, তার তুলনা হয় না।
মাহফুজ মোহাম্মদপুরে এক সঙ্গে শ্বশুরএবং শালা-শালিদের নিয়ে থাকে। একদিন তার ওখানে শাহরিয়ারের খবর নিতে গেলাম। মাহফুজ বলেছিল লেপ তোশকের দোকানের পেছন দিক দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বেল টিপতে। ওটাই ঊনত্রিশ নম্বর। দোতলায় উঠে বেল টিপলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। ম্যাক্সি পরা একটি যুবতী মহিলা বেরিয়ে এসে কাট কাট জিজ্ঞেস করলেন, কাকে চান? আমি বললাম, মাহফুজ সাহেবকে। মহিলা আমাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, পাশের দরজায় বেল টিপুন। পাশের দরজায় বেল টিপতেই একটি বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে এসে বলল, কার কাছে আইছেন? আমাকে আবার মাহফুজ সাহেবের নাম বলতে হলো। মেয়েটি বলল, আমার পাছ পাছ আইয়েন। একটি প্যাসেজ মতো করিডোর পার করিয়ে একটা বদ্ধ দরজা দেখিয়ে বলল, ওই হানে কড়া নাড়েন। কড়া নাড়লাম। মাহফুজ স্বয়ং দরজা খুলে দিলেন। আমি তার ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে-না-বসতেই মাহফুজ বলে ফেললেন, জাহিদ ভাই আমি ঠিক করেছিলাম আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না। বাসায় আসছেন যখন কথা তো বলতেই হবে, কি খাবেন কন? আমি বললাম, আমার সঙ্গে যে কথা বলতে চান না, আমি অপরাধটা কি করলাম? মাহফুজ বললেন, সমস্ত অপরাধ তো আপনার । আপনি কোত্থেকে শামারোখ না কি এক ডাকিনী মহিলাকে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে বসিয়েছেন, সে তো এদিকে সর্বনাশ করে ফেলেছে। আমি বললাম, একআধটু সর্বনাশ করার ক্ষমতা না থাকলে সুন্দরী হয়ে লাভ কি? শামারোখ কোথায় কার সর্বনাশটা করল বুলন দেখি। মাহফুজ পুনরায় জানতে চাইলেন, এই মহিলার সাম্প্রতিককালের কাজকর্ম সম্পর্কে আপনি কিছু কি জানেন? আমি বললাম, এত দ্রুতগামী মানবী শামারোখ তার সমস্ত কাজকর্মের হিসেব রাখা একজন মানুষের পক্ষে কি সম্ভব? তিনি বললেন, ওই ডাকিনী তো শাহরিয়ারকে খুন করতে যাচ্ছে। আমি বললাম, তাই নাকি? তাহলে তো একটা কাজের কাজ করছে। শাহরিয়ারকে পুরিসির মতো জবরদস্ত রোগ খুন করতে পারল না, আর তাকে শামারোখ খুন করবে! তাহলে তো একটা ঘটনাই ঘটে যায়। মাহফুজ বললেন, রসিকতা বাদ দিয়ে আসল ব্যাপার শুনুন। মাহফুজের কথা শুনে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।
শাহরিয়ারকে মার্কিন ডাক্তার বলেছেন, চার বছর তাকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাকে ঠিক সময়ে খেতে হবে, ঠিক সময়ে ঘুমোতে হবে। ওষুধ-পথ্য সব যথাযথ নিয়মে চালিয়ে যেতে হবে। ওই নিয়মের যদি খেলাপ হয় তাহলে পুরনো রোগটা আবার নতুন করে দেখা দেবে। যদি রোগ নতুন করে দেখা দেয় তাকে বাঁচানো আর সম্ভব হবে না। শামারোখের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে শাহরিয়ার ওষুধ-পথ্য কিছুই ঠিকমতো খাচ্ছে না। মহিলার সঙ্গে দেশের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন বারোটা একটা অবধি রাত জাগছে। অহরহ সিগারেট টানছে। শাহরিয়ারকে ওই মহিলার সঙ্গে ছুটোছুটি করতে বারণ করলে কিছুতেই সে শোনে না, অনর্থক রাগারাগি করে। মাহফুজ বললেন, আমি অনেক করে শাহরিয়ারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি, তুমি একটা সিরিয়াস রোগী, এ ধরনের অনিয়ম করে গেলে তোমার শরীর ওই ধকল সহ্য করবে না। আমি বললাম, শাহরিয়ার কি বলল। মাহফুজ বললেন, সে কথা আর বলে লাভ কি? সে বলে পৃথিবীতে একজন মানুষও যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে সেই একজন মানুষ হলো শামারোখ । অন্য সব ব্যাপারে সে পরামর্শ-উপদেশ ওসব শুনতে রাজি। কিন্তু শামারোখের বিষয়ে শাহরিয়ার কারো কোনো কথা শুনবে না।
আমি বললাম, শামারোখকে শাহরিয়ারের রোগের ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন? মাহফুজ বললেন, সে অত্যন্ত খতরনাক মেয়ে মানুষ। আমি মহিলাকে শাহরিয়ারের রোগের কথা জানিয়ে সতর্ক করতে চেষ্টা করলে ওই অসভ্য মহিলা আমার মুখের ওপর বলে বসল, শাহরিয়ারের কোনো ভাবনা আর তার বন্ধুদের না ভাবলেও চলবে। সব দায়-দায়িত্ব শামারোখ একা তার ঘাড়ে করে তুলে নিয়েছে। আমি বললাম, একদিক দিয়েতো ভাল হলো। শাহরিয়ারের শরীরের ওই অবস্থায় এরকম কেউ একজন থাকা তো প্রয়োজন, যে তাকে সর্বক্ষণ দেখাশোনা করতে পারে । শামারোখকে আমি যতটুকু জানি, যে মানুষকে সে ভালোবাসে তার জন্য এমন আত্মত্যাগ নেই যা সে করতে পারে না। মাহফুজ বললেন, দেখবেন অবস্থাটা কি দাঁড়ায়। এরকম চলতে থাকলে চারমাসও সুস্থ থাকতে পারে কিনা সন্দেহ। মাঝখান থেকে আমার মেহনতটাই বরবাদ। গত আট বছর ধরে শাহরিয়ারকে আগলে আগলে রাখছি। এখন আমি কেউ নই শাহরিয়ারের। ওই মহিলাই সব। মহিলা আজকাল আমাকে শাহরিয়ারের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয় না। মাহফুজের কথার মধ্যে একটা গভীর বেদনার আভাস পাওয়া গেল। আমি মাহফুজের দুঃখটা অনুভব করতে পারি। মাহফুজ গত আট বছর শাহরিয়ারের জন্য যা করেছেন, কোনো মানুষ তার নিকটাত্মীয়ের জন্যও অতটা করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাহরিয়ারকে পাঠানোর জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দিনে-রাতে খেটেছেন। মার্কিন দেশের হাসপাতালে ভর্তি করানো, সরকারের ঘর থেকে টাকা-পয়সা সংগ্রহ, পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা করা সবকিছুর ধকল একা মাহফুজকেই পোহাতে হয়েছে।