আমি মেসে এসে শাহরিয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম ওঠানোর জন্য কত টাকা প্রয়োজন? শাহরিয়ার হিসেবটিসেব করে বলল, জাহিদ ভাই, সব মিলিয়ে একশ পঁয়ত্রিশ টাকা প্রয়োজন। আমি তার হাতে একশ টাকার একটি, তিনটি দশ এবং একটি পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললাম, এই তোমার একশ পঁয়ত্রিশ টাকা। রেজিস্ট্রার অফিসে জমা দিয়ে নামটা তোলার ব্যবস্থা কর। শাহরিয়ার হাত পেতে টাকাটা নিল। টাকাটা তাকে দিতে পেরে আমার কী যে ভাল লাগল, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার প্রথম লেখার টাকা দিয়ে একজন তরুণ কবির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া রোধ করতে পারলাম। তার পরদিন সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখি শাহরিয়ার ফজলুর রহমানের সঙ্গে বসে বসে কেরাম খেলছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগল। প্রথম লেখার টাকা দিয়ে তোমার নামটা ওঠাবার ব্যবস্থা করলাম, আর তুমি ক্লাশে না গিয়ে সকালবেলাটা কেরাম খেলে কাটিয়ে দিচ্ছ! অবশ্য মুখে শুধু বললাম, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছ না? শাহরিয়ার বলল, জাহিদ ভাই, কাল আপনি রাত করে এসেছিলেন, তাই আপনাকে বলা হয় নি। আমার নাম উঠিয়েছি, তবে আরো পঁয়তাল্লিশ টাকা দিতে হবে। সেমিনার চার্জ পঁয়তাল্লিশ টাকা, হিসেব করার সময় আমার মনে ছিল না। আমি বললাম, আর পঁয়তাল্লিশ টাকা দিলে তোমার নাম উঠে যাবে তো? শায়রিয়ার বলল, নাম তো উঠে গেছে। এই চার্জটা আলাদা দিতে হবে। আমি বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকাল কি ছুটাছুটাভাবে ফি আদায় করা হয়। শাহরিয়ার বলল, হ্যাঁ, এরকম একটা নতুন নিয়ম করা হয়েছে। আমি বাক্যব্যয় না করে আরো পঁয়তাল্লিশ টাকা তার হাতে তুলে দিলাম।
সে রাতে শাহরিয়ার আর মেসে ফেরে নি। তারপরের রাতেও না। আমি তার কোনো বিপদআপদ হয়েছে কিনা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। এই সময়ে ফজলুর রহমান এসে আমাকে আসল খবর জানালো। সে বলল, জাহিদ ভাই, শাহরিয়ার তো আপনার খুব পেয়ারের লোক। আর আমাদের মনে করেন নষ্ট মানুষ। আপনি মনে করেন আমাদের সংসর্গে থাকলে আপনার শাহরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। কে কাকে নষ্ট করছে, আপনাকে আজ হাতেনাতে দেখিয়ে দেব। আপনি প্যান্টটা পরুন এবং চলুন আমার সঙ্গে।
ফজলুর রহমান আমাকে বাবু বাজারের একটা কানাগলির মধ্যে নিয়ে এল। প্রস্রাবের গন্ধে পেটের নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায় সেই সরু গলির মধ্যে খোপ খোপ ঘর। প্রতি ঘরের সামনে রঙচঙ মাখা একেকজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা শরীরে এমনভাবে পাউডার মেখেছে, মনে হয়, মাগুর মাছের শরীরে ছাই মাখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এই সেই ঢাকা শহরের প্রসিদ্ধ পতিতা পট্টি। ঘেন্নায় আমার নাক মুখ কুঞ্চিত হয়ে এল। আমি ফজলুর রহমানকে বললাম, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে? ফজলুর রহমান বলল, জাহিদ ভাই, উতলা হচ্ছেন কেন, আপনাকে আসল জায়গাতেই নিয়ে এসেছি। আপনি আমার পেছন পেছন আসুন। আপনার সঙ্গে কবি শাহরিয়ারের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেব। ফজলুর রহমান এবারে একটি ঘরের দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, এই দরজায় আপনি টোকা দিন, শাহরিয়ারের দেখা পেয়ে যাবেন।
আমি সেই বন্ধ ঘরের কাঠের কপাটে টোকা দিতে থাকলাম। ভেতর থেকে লোকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। এক সময় নারী কণ্ঠের একটা আওয়াজ শুনলাম, আউজকা অইব না, অন্য ঘরে যাও। আমার ঘরে লোক আছে। সেই কথা শোনার পরও আমি টোকা দিয়ে যেতে থাকলাম। অবশেষে দরজা খুলে গেল। একটি মেয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ঢেমনির পুত তোরে কই নাই আমার ঘরে আইজ মানুষ আছে। মেয়েটির পরনে ব্লাউজ এবং সায়া ছাড়া শরীরে আর কোনো বসনের বালাই নেই। আমি একেবারে তার মুখোমুখি চলে এলাম। ভক ভক করে দেশী মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। তাকে হাত দিয়ে ঠেলে আমি ঘরে ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল । আমার পরিচিত আরেকজন বুড়ো কবির সঙ্গে বসে বসে শাহরিয়ার বাংলা মদ টানছে। আমার প্রথম বই লেখার টাকা কোন সুড়ঙ্গ পথে যাচ্ছে বুঝতে বাকি রইল না । শাহরিয়ারের চুল ধরে কিল-চড় মারতে আরম্ভ করলাম। তাকে কিল-চড় মেরেই যাচ্ছিলাম, কি করছি আমার কোনো হুঁশ ছিল না। এই ফাঁকে সেই পরিচিত বুড়ো কবি কোথায় উঠে পালাল, খেয়াল করতে পারি নি। এখন ভেবে অবাক লাগে শাহরিয়ার আমাকে পাল্টা মার দিতে চেষ্টা করে নি কেন? মেয়েটি আমাকে থামাবার অনেক চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত বিফল হয়ে পাড়ার গুণ্ডাটিকে ডেকে আনল। গুণ্ডাটি এসে আমার ঘাড়ের কাছে এমন একটা ঘুষি লাগাল যে, আমাকে বসে পড়তে হলো। তারপরে মারতে মারতে একেবারে কাহিল করে ফেলে চুল ধরে সেই নোংরা গলি দিয়ে হাঁটিয়ে এনে সদর রাস্তার ওপর ছেড়ে দিল। আমি এদিক ওদিক তাকালাম। কিন্তু ফজলুর রহমানের চিহ্নও কোথায়ও দেখতে পেলাম না।
এই ঘটনার পর থেকে শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার আর কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় নি। কিন্তু তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা আমার বন্ধ হয় নি। একই শাহরিয়ারের মধ্যে আমি দুজন মানুষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। এক শাহরিয়ার ছিল নিরীহ, ফুলের মতো কোমল। তার চোখের দিকে তাকালে বনের হরিণের কথা মনে পড়ে যেত। হরিণের মতো তার চোখে একটা অসহায়তার ভাব ছল ছল জেগে থাকত। আরেক শাহরিয়ার ছিল চালবাজ, অকৃতজ্ঞ এবং লোভী। তবু শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে আমার কোনো নালিশ নেই। শাহরিয়ার বেশ্যাপাড়ায় যাতায়াত করেছে এবং বেশ্যাসক্ত হয়ে পড়েছে এ নিয়েও বলার কিছু ছিল না। কারণ কবিতা লেখা এবং বেশ্যাসক্ত হওয়া একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কবি যশোপ্রার্থী তরুণেরা অনেকেই যেত, শাহরিয়ার ছিল তাদেরই একজন। সে সময়ে বেশ্যাপাড়ায় যাওয়াটা একটা বিশেষ মর্যাদার ব্যাপার বলে ধরে নেয়া হতো।