শাহরিয়ারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে কামাল সাহেবের অফিসে। কামাল সাহেব একটি ছোট গল্পের পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তিনিই প্রথম আমাকে শাহরিয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, জাহিদ ভাই আপনাকে আমার পত্রিকার এক নতুন লেখকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, ছোট গল্প লেখে। কথা বলে দেখুন, আপনার ভাল লাগবে । শাহরিয়ার যখন কথা বলল, কণ্ঠস্বর শুনেই আমার মনে একটা ভাবান্তর এসে গেল। ভরা কলসির পানি ঢালার সময় যেমন থেকে থেকে একটা মিষ্টি সুন্দর আওয়াজ সৃষ্টি হয়, শাহরিয়ারের কণ্ঠস্বরে সে রকম একটা জল ছলছল ভাবের আভাস আমার শ্রবণে মননে বিধে গেল। ছেলেটিকে তো আমার মনে ধরে গেল।
তারপরে তো শাহরিয়ার গল্প ছেড়ে কবিতা লিখতে আরম্ভ করল। আমি কবিতার সমঝদার নই। তবু শাহরিয়ারের কবিতার মধ্যে এমন একটা মেজাজ পেয়ে যেতাম, বক্তব্য বিষয় ছাপিয়ে গড়ানো পঙক্তিসমূহের ভেতর থেকে শব্দ শুনছি, শব্দ শুনছি, জল চলছে জল চলছে এমন একটা ভাব বেরিয়ে এসে আমাকে আবিষ্ট করে রাখত। মাত্রা ভুল এবং ছন্দগত ত্রুটিকে উপেক্ষা করেও শাহরিয়ার তার কবিতায় আশ্চর্য একটা সম্মোহন সৃষ্টি করতে পারত। এটাই শাহরিয়ারের আসল ক্ষমতা। কিন্তু শাহরিয়ারের কবিতার প্রতি আমার মুগ্ধতা-বোধ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নি। এক সময় তার কবিতা আর পড়তে পারতাম না। পড়লেও বিরক্ত হয়ে উঠতাম। কারণ কবিতায় আমি অন্য জিনিস চাইতাম।
শাহরিয়ারের কবিতা পছন্দ করিনে বলে তার তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের চিড় ধরে নি। শাহরিয়ার যে আমার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক সময় আমার সঙ্গে থাকতে আসে। কজন বন্ধু মিলে আরমানিটোলার হোটেল ওরিয়েন্টের দুতিনটে রুম ভাড়া করে একটা মেস চালু করেছিলাম। সেই মেসে শাহরিয়ার আমার সঙ্গে থাকতে আসে। সে ছাত্র পরিচয়ে আমাদের এখানে এসেছিল। কিন্তু মেসের সদস্য ছিল না। আমার গেস্ট হিসেবেই থাকত। কদিন না যেতেই একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। শাহরিয়ার ঠিক সময়ে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না। আজেবাজে মানুষদের সঙ্গে চলাফেরা করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। এরকম তিন চারদিন দেখার পর, একদিন আমি বললাম, শাহরিয়ার তুমি য়ুনিভার্সিটিতে যাচ্ছ না। কেন? সে বলল, জাহিদ ভাই, সেটা একটা দুঃখের কথা। আমি বললাম, বলে ফেল, কি দুঃখের কথা। সে বলল, আপনাকে জানাতে আমার ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। আমি বললাম, আমরা এমন এক অবস্থায় বাস করছি যেখানে সংকোচ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তোমার দুঃখের কথাটা বলে ফেল। শাহরিয়ার বলল, জাহিদ ভাই, ডিপার্টমেন্টে আমার নামটা কাটা গেছে। তিনমাস টুইশন ফি দিই নি। আব্বাও টাকা পাঠাচ্ছেন না। আমি ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। আপনাদের এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা না হলে আরো বিপদে পড়ে যেতাম।
শাহরিয়ারের নামটা কাটা যাওয়ার সংবাদ শুনে আমি খুব ব্যথিত বোধ করলাম । বিশ্ববিদ্যালয়ে আমারো নাম কাটা গিয়েছিল। আজ তুলব, কাল তুলব করে টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় আমার নামটি তোলা আর সম্ভব হয় নি। এক সময় পড়াশোনাটা আমার বাদ দিতে হলো। একই ব্যাপার শাহরিয়ারের ক্ষেত্রেও ঘটতে যাচ্ছে।
সে সময় বাংলাবাজারের এক প্রকাশকের কাছে আমি একটা উপন্যাস গছাতে পেরেছিলাম। আমি একেবারে নাম-পরিচয়হীন উগ্র একজন তরুণ লেখক। আমার লেখা প্রকাশক ছাপার জন্য গ্রহণ করবেন কি না, সে ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তবু পরদিন সকালবেলা প্রকাশকের বাড়িতে গিয়ে দাবি করে বসলাম, তাদের তো আমার উপন্যাসটি ছাপতে হবে, উপরন্তু অগ্রিম হিসেবে আজই দেড় হাজার টাকা রয়্যালিটি পরিশোধ করতে হবে । প্রকাশক ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে, আপনি আজই পনেরশ টাকা নিয়ে যান। কিন্তু বই ছাপার জন্য চাপাচাপি করবেন না। আমাদের সময় হলেই বই প্রেসে যাবে।
আমার হাতে প্রকাশক ভদ্রলোকের দেয়া কড়কড়ে নোটের পনেরশ টাকা। আমার প্রথম উপন্যাস লেখার টাকা। দক্ষিণ মেরু জয় করে এলেও আমার এরকম আনন্দ হতো না। এ টাকা দিয়ে কি করব, তাই নিয়ে একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। কখনো মনে হলো আমার প্রিয় লেখকদের বইগুলো কিনে ফেলি। আবার ভাবলাম, বই কেনা আপাতত থাকুক। আমি ঠিক সময়ে টাকা শোধ করতে পারি নি বলেই আরমানিটোলার মেসের বন্ধুদের কষ্ট করতে হয়। তাদের সবাইকে নিজের হাতে বাজার করে একবেলা ভাল খাওয়াবো। আবার ভাবতে হলো মাকে আমি আপন রোজগারের টাকা এ পর্যন্ত কোনোদিন পাঠাতে পারি নি। সামান্য হলেও কিছু টাকা মার কাছে পাঠাতে হবে। নিজের জামা-কাপড়ের দিকেও তাকালাম। আমার পরনের শার্ট একটিতে এসে ঠেকেছে। একটা নতুন শার্ট না বানালে আর চলে না। শীত এসে গেছে। একটা গরম সুয়েটার বা জ্যাকেট কেনা প্রয়োজন। বই কেনা, মেসের লোকদের খাওয়ানো, মার কাছে টাকা পাঠানো এবং নিজের জামাকাপড় কেনা ওসব বিষয় একপাশে ঠেলে রেখে ভাবলাম, আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় শাহরিয়ারের নাম উঠানো প্রয়োজন। নাম ওঠানোর পরে যদি বাকি টাকা থাকে অন্য সমস্ত কিছু করা যাবে।