আমি বেরিয়ে আসছিলাম। কিন্তু কামাল পথ আটকালেন, জাহিদ ভাই, পালাচ্ছেন কোথায়? আমি বললাম, পালাচ্ছি না। একটু কাজ আছে। কামাল বললেন, আপনার যে এখন অনেক কাজ সে তো আমরা জানি। কিন্তু আমাদের খাওয়া কোথায়? আমি বললাম, কিসের খাওয়া? তিনি বললেন, বা রে আপনি বিয়ে করবেন আর আমাদের খাওয়াবেন না! পেয়েছেনটা কি? আমি জানতে চাইলাম, কোথায় শুনেছেন আমার বিয়ে হয়েছে। তিনি বললেন, শোনাশুনির মধ্যে নেই, যাকে বিয়ে করেছেন তিনিই বলেছেন। আমি বললাম, ওই তিনিটা কে?
আর কে? আমাদের সুন্দরী শ্ৰেষ্ঠা বেগম শামারোখ ।
কথাটা শুনে আমি কেমন থতমতো খেয়ে গেলাম। শামায়োখটা কি? সে কি পাগল, না মতলববাজ? আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে না তো? আমি দেখলাম এই সময় ময়ূরের মতো পেখম মেলে শামারোখ লাউঞ্জে ঢুকছে। আমি স্থানকালের গুরুত্ব ভুলে গিয়ে শামারোখকে ডাক দিলাম, এই যে শামারোখ, শোনেন তো। শামারোখ অনেকটা উড়তে উড়তে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ তার মনে খুব ফুর্তি। আমি বললাম, সুসংবাদটা আমি এই এক্ষুনি পেলাম। আপনি একেবারে না জানিয়ে যে আমাকে বিয়ে করে বসলেন, কাজটা ঠিক হয় নি। অন্তত খবরটা আমাকে জানানো উচিত ছিল। কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে আমি চেয়ারম্যান সাহেবের খোঁজে বেরিয়ে গেলাম। কোথাও তাকে না পেয়ে ঘরে এসে নিজেকে সটান বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম। আজ টাকা না দিলে বজলু খাবার দেবে না বলেছে।
আমার চোখে তন্দ্রার মতো এসেছিল। ভেজানো দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। চেয়ে দেখি শামারোখ। তার মুখ লাল, চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। অনেকটা চিৎকার করেই বলল, এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে অপমান করার সাহস আপনার হলো কেমন করে? আমি বললাম, আমাকে না জানিয়ে একেবারে বিয়ে করার সাহস কি করে আপনি পেলেন, আগে বলুন। সে বলল, আপনি একটা শয়তান। আমি এক্ষুনি মজা দেখাচ্ছি। এক্ষুনি আমি দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছি। তখন বুঝবেন মজা। সে রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । তার এই হুমকির মুখে আমার মনে কৌতুকবোধ চাড়া দিয়ে উঠল। আমি চেয়ারটা রেলিংয়ের গোড়ায় এগিয়ে দিয়ে বললাম, এই চেয়ারে ভর দিয়ে রেলিংয়ের ওপর দাঁড়ান। তারপর শরীরটা ওপাশে ছুঁড়ে দিন। সে এক কাণ্ড হবে। মজা আমি একা নই রাস্তায় যেসব ছাত্র যাওয়া-আসা করছে, তাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললাম, তারাও দেখবে। আপনার ভেতরের সুন্দর থেতলে যাওয়া অঙ্গ-প্রতঙ্গ সবার সঙ্গে আমিও দেখতে পাব। দাঁড়িয়ে কেন, দিন, লাফ দিন।
শামারোখ রেলিংয়ের গোড়া থেকে সরে এসে আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে বলতে লাগল, আপনি একটা বদমাশ, লুচ্চা। জহরত আরার সঙ্গে কি করেন, আধারাত সুলতানার বাড়িতে কী রকম আসনাই করে কাটান, আজ সব বলে দেব। একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। আমি বললাম, প্রথম যে কাজটা করতে চেয়েছিলেন সেটার চাইতে একটু খারাপ। তবু মন্দ না, দিন হাটে হাঁড়ি ভেঙে। সে ছুটে এসে আমার বাহুমূলে একটা কামড় বসিয়ে দিল। আমি একটা মশারির স্ট্যান্ড ভেঙে তাই দিয়ে তাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলাম। ঠিক কোন্ সময়ে কোন উপলক্ষে শাহরিয়ারের সঙ্গে শামায়োখের পরিচয় হয় আমি বলতে পারব না। শাহরিয়ার তখন সবে আমেরিকা থেকে এসেছে। ওখানকার ডাক্তারেরা তার রোগের কেমন চিকিৎসা করেছেন, সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা আছে কি না, আমি কোনো কিছু জানি নে। শুধু সংবাদপত্রের খবর থেকে জানতে পেরেছি, আমেরিকা থেকে চিকিৎসা করিয়ে শাহরিয়ার দেশে ফিরেছে।
শাহরিয়ারের বর্তমান অবস্থা কেমন, সে কোথায় থাকছে এসব খবরও আমাকে কেউ জানায় নি। আমারও এত ব্যস্ত সময় কাটছে, নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে তার ব্যাপারে তত্ত্বতালাশ করার কোনো অবকাশ হয় নি। একদিন কোনো একটা পত্রিকায় শাহরিয়ারের একটা কবিতা পড়লাম। পড়ে চমকে গেলাম। এই রকম একটা কবিতা শাহরিয়ারের কলম থেকে বেরুল কেমন করে? কবিতাটি পড়ার পর আমার চেতনায় একটা বিদ্যুৎ-প্রবাহ খেলে গেল। কবিতাটি বার বার পড়তে হলো। সাদা চোখে দেখলে এটাকে প্রেমের কবিতা বলতে হবে এবং শাহরিয়ারও একজন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছে। কবিতার বাক্যকে ছাড়িয়ে আরো একটা গভীর অর্থময়তা আমার চেতনার দুয়ারে দুয়ারে টোকা দিতে থাকল। কবিতাটি উদ্ধৃত করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। তাই উদ্ধৃত করা গেল না। একটি বিষাদের ভাব আমার মনে চারিয়ে গেল। শাহরিয়ার কাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছে? সে কি কোনো নারী- না তার মৃত্য? মৃত্যু কেন সুন্দরী নারীর মূর্তি ধরে এমন শোভন সুন্দর বেশে তার কবিতায় এসে দেখা দিল!
সেই মুহূর্তে শাহরিয়ারকে এক ঝলক দেখার আকাঙ্ক্ষা, তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার মনে তীব্র হয়ে উঠল। শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার এমন কোনো গভীর সম্পর্ক আছে, সে কথাও ঠিক নয়। আমাকে শাহরিয়ার বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। লোকজনের সামনে আমাকে অপদস্থ করতেও তার বাধে না। সে আমার চাইতে বয়সে ছোট। শাহরিয়ার এই বয়সের ব্যবধানের কথা ভুলে গিয়ে আমাকে আক্রমণ করত। বয়সে বড় হওয়ার এই এক দোষ। কম বয়সী কেউ আক্রমণ করলে পাল্টা অক্রমণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আবার আঘাতটাও বুকে বাজে। এই ধরনের বিদঘুঁটে পরিস্থিতির মুখোমুখি যাতে না হতে হয়, সে জন্য আমি শাহরিয়ারকে এড়িয়ে চলতাম। আমার সম্পর্কে শাহরিয়ার যাই-ই মন্তব্য করুক না কেন আমি জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করতাম না। আমি জানতাম, আসলে এগুলো তার নিজের কথা নয়। যেসব মানুষের সঙ্গে ইদানীং তার চলাফেরা শাহরিয়ার তার নিজের মুখ দিয়ে তাদের কথাই প্রকাশ করছে। এমনও সময় গেছে মাঝে মাঝে শাহরিয়ারের সঙ্গে আমার দুতিনমাসও দেখা হয় নি। এই অদর্শনের সময়টিতে শাহরিয়ারের কথা যখন মনে হতো, তার সঙ্গে আমার কখনো মনোমালিন্য হয়েছে, কখনো ঝগড়াঝাটি হয়েছে, সেসব ব্যাপার একেবারেই মনে থাকত না। তার মুখ এবং চোখ দুটোই আমার মনে ভেসে উঠত। শাহরিয়ারের মুখের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল, আমার চোখে সেরকম কিছু ধরা পড়ে নি। তবু মাঝে মাঝে মনে হতো, কোনো ভাস্কর যদি মূর্তি গড়ে, তার মুখমণ্ডলটি তৈরি করার বেলায় তাকে গভীর অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিতে হবে। যদিও শাহরিয়ার প্রকৃতিতে ছিল খুবই চঞ্চল, তথাপি তার মুখে একটা ধ্যান-তন্ময়তার ভাব সময় সময় লেগে থাকত। সবচাইতে সুন্দর ছিল তার চোখ দুটো। পুরুষ মানুষের এমন আশ্চর্য সুন্দর চোখ আমি খুব কমই দেখেছি। যেদিকেই তাকাতো, মনে হতো, একটা স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার ধারণা শাহরিয়ারের সঙ্গে মতামতের গড়মিল সত্ত্বেও খুব সহজে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে তার যে বন্ধুত্ব হয়ে যেত, তার প্রধান কারণ ছিল তার চোখের দৃষ্টি।