এ কমাসে আমি সবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে উঠেছি। এটাই শামারোখের প্রত্যক্ষ অবদান। নিচের দিকের ছাত্রেরা আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। জুনিয়র শিক্ষকেরা ঈর্ষা করেন। শামারোখের মতো অনিন্দ্য সুন্দরী এবং বিদূষী মহিলাকে আমি পেছন পেছন ঘোরাচ্ছি, কি আছে এমন আমার। আমি সুদর্শন চেহারার অধিকারী নই। চাকরি নেই বাকরি নেই, একেবারে অসহায় মানুষ আমি। শামারোখ আমার মধ্যে কি দেখতে পেয়েছে! এরকম কথা সবাই বলাবলি করত। এই ধরনের প্রচারের একটা মাদকতার দিক তো অস্বীকার করা যায় না। আমার টাকা নেই, পয়সা নেই, রূপ নেই, গুণ নেই, তারপরও আমি মনে করতে থাকলাম, আমার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যার কাছে বাড়ি-গাড়ি, টাকা বিদ্যে-বুদ্ধি সব হার মেনে যায়। সে হলো আমার পৌরুষ । কখনো কখনো নির্জন মুহূর্তে আমি নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষ মনে করতাম। সুন্দর মহিলাদের কেন পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়, তার হেতু আমি এখন বুঝতে পারছি। একমাত্র সুন্দরের বাতাবরণের মধ্য দিয়ে মিথ্যেকে সত্যে রূপান্তরিত করা যায়। তরুণ মেয়েরা যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসত। কখনো কখনো মনে হতো মেঘেতে ঠেকেছে আমার মস্তক।
এদিকে কি দশায় আমি এসে দাঁড়িয়েছি সে বিষয়ে একটু ধারণা দিতে চেষ্টা করি। বজলুর মেসে তিন মাসের খাওয়ার বিল আমি শোধ করতে পারি নি। বজলু খাবার বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। বালিশ, বিছানার চাদর, মশারি ইত্যাদি চরম দফায় এসে পৌঁছেছে। বাড়ি থেকে ক্রমাগত টাকার তাগাদা জানিয়ে চিঠি আসছে। আমি এখন কি করি, আমাকে নিয়ে নানা রঙিন কাহিনী তৈরি হচ্ছে। অথচ আমার নাশতা কেনার পয়সা নেই। গুরুজনদের সামনে দাঁড়াতে পারছি নে। তাদের সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যেতে পারি নে, তারা আমাকে ঈর্ষা করেন। এক সময়ে আমি সাহস করে বলতাম, শামারোখ যদি বলে তার পেছন পেছন পৃথিবীর অপর প্রান্ত অবধি ছুটে যাব। পৃথিবীর অপর প্রান্তে চলে যাওয়াটাই বোধহয় আমার জন্য ভাল ছিল। আমাকে অসংখ্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টির বিরাগভাজন হয়ে এমন করুণ জীবন যাপন করতে হতো না। শামারোশের কল্যাণে এখানে আমি যে জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি তার নাম সীমাহীন শূন্যতা। নামতেও পারি নে, উঠতেও পারি নে। হাজার জনতার মাঝখানেও এমন নিঃসঙ্গ জীবন একজন মানুষ কেমন করে যাপন করে?
মেয়েদের হোস্টেলে সুলতানা জাহান হাউজ টিউটরের কাজ করে। সে আমাকে ভাই বলে ডাকে। ছ’ মাসও হয় নি বেচারির স্বামীটি খুন হয়েছে। তার তিনটি বাচ্চা। তার এত সময় এবং সুযোগ কোথায় যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হৃদয়, দহন, স্থলন, পতন, কেলেঙ্কারি এসবের দিকে মন দেয়। আমি প্রায় দিন সন্ধ্যেবেলা সুলতানার বাড়িতে যাই। তার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলো করে সময় কাটিয়ে আসি। আমিও এক ধরনের স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছিলাম। ক্রমাগত উত্তেজনা থেকে উত্তেজনার মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের ওপর একরকম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছিলাম। সুলতানার বাসাতে যখন যেতে আরম্ভ করি, তার শিশুদের সঙ্গে যখন সময় কাটাতে থাকি, যখন এই দুঃখী গরিব সংসারের হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভাবের দিকে দৃষ্টিপাত করতে থাকি, আমি অনুভব করলাম, আমার ভেতরে একটা প্রশান্তির রেশ ফিরে আসছে। এই দুঃখী বোনটির প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল। তাকে অর্থ-কড়ি দিয়ে সাহায্য করব, এমন ক্ষমতা আমার কোথায়? তবু তার বাড়িতে এটা-ওটা নিয়ে যেতাম। কখনো বাচ্চাদের খেলনা, কখনো কোনো খাবার কিংবা মওসুমের নতুন ফল। বাচ্চারা এই সামান্য জিনিস পেয়ে কী যে খুশি হয়ে উঠত! তাদের খুশিতে আমি নিজেও খুশি হয়ে উঠতাম। সুলতানার বাড়িতে আমি প্রায় ন’টা অবধি থাকতাম। না খাইয়ে সুলতানা আমাকে আসতে দিত না।
একদিন সুলতানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোস্টেলের গেট অবধি এসেছি, পেছন থেকে ডাক শুনলাম, দাঁড়ান। বুঝতে পারলাম, শামায়োখ। সে কি এই হোস্টেলে থাকতে আরম্ভ করেছেন? বুঝলাম সুলতানার বাড়িতে আসাও আমার বন্ধ করতে হবে। একদিন সুলতানার বাড়ি থেকে ফিরতে রাত এগারটা বেজে গিয়েছিল। কারণ সুলতানার ওখানে দেশের বাড়ি থেকে কিছু আত্মীয়-স্বজন এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে গল্পগাছা করতে করতে এতটা রাত পার করে ফেলেছি, সেদিকে খেয়ালও করি নি। সিঁড়ি থেকে যখন পথে নামলাম অমনি কারেন্ট চলে গেল। পথঘাট ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। পা ফেলা দায়। শামারোখের কণ্ঠস্বর শুনলাম, এই অন্ধকারে আপনি যাবেন কেমন করে? আমি বললাম, যেতে পারব। কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যে কি করছেন? শামায়োখ খিলখিল করে হেসে উঠল। মনে হলো বোতল ভাঙা কাঁচের মতো তার হাসির রেশ অন্ধকারকে বিদ্ধ করল। সে বলল, জানতে চান, আমি কি করছি? এত রাতে এই বিধবা মহিলার বাড়িতে কি করেন, জানার জন্য পাহারা দিচ্ছি। আমার ইচ্ছে হলো চড় বসিয়ে দিই। তারপরের সপ্তাহে সুলতানার বাড়িতে যখন গেলাম, সে হাতজোড় করে জানালো, জাহিদ ভাই, আপনি আমাদের এখানে আর আসবেন না। মুখটা ফিরিয়ে সে কেঁদে ফেলল।
শিক্ষকদের লাউঞ্জে যাওয়া আমাকে একরকম ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবু মাসের তিন তারিখে আমাকে যেতে হতো। চেয়ারম্যানের খোঁজে আমি ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। কারণ তিনি ফর্মে সই না করলে আমি স্কলারশিপের টাকা ওঠাতে পারব না। পিয়ন জানালো, তিনি অফিসে নেই, তবে লাউঞ্জে থাকতে পারেন। আমি তার খোঁজে লাউঞ্জে গেলাম। দেখলাম তিনি ওখানেও নেই। মস্ত ফাপড়ে পড়ে গেলাম। আজকেই আমার টাকাটা ওঠানো প্রয়োজন। আমি টাকা না দিলে বজলু রেশন তুলতে পারবে না। চেয়ারম্যান সাহেবকে কোথায় পাওয়া যায় খোঁজ করে দেখা প্রয়োজন।