আমার শিক্ষিকা তাহমিনা খানের কাছ থেকে আমি কিছু টাকা ধার করেছিলাম। অনেক দিনের পুরনো ঋণ শোধ করব-করব করেও করা হয় নি। অত টাকা এক সঙ্গে জড়ো করা সম্ভব হয় নি। এই ঋণটার জন্য তাহমিনা খানের কাছে আমার মুখ দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। সেদিন আমার প্রকাশক আমার বইয়ের রয়্যালটি বাবদ কিছু টাকা দিয়ে গেলেন, আমি স্থির করলাম, প্রথমেই তাহমিনা ম্যাডামের ঋণটা শোধ করব। টাকাটা যদি রেখে দিই অন্য কাজে খরচ করে ফেলব। সুতরাং টাকাটা শোধ করতে ছুটলাম। সকালের দিকে তার ক্লাশ থাকে, ডিপার্টমেন্টে অথবা তার ঘরে নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।
তাহমিনা ম্যাডামের কথা সামান্য পরে বলব। তার আগে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী সম্পর্কে একটা মজার কথা বলে নিই। শুধু আমি নই, এ পাড়ার সকলেই জানেন, ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী প্রবন্ধ-ব্যাকরণের মতো মানুষ। তার রসবোধ অল্প। অথচ তিনি মাঝে মাঝে রসিকতা করেন না, এমন নয়। কিন্তু সেগুলো এমন বানিয়ে তোলা যে তাতে রসের ভাগ থাকে নিতান্ত অল্প, খিস্তির ভাগ থাকে বেশি। কিন্তু এইবার একটি কাজ করে তিনি যে সত্যি সত্যি রসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তিনি দুই তারকা-শিক্ষিকা শামারোখ এবং তাহমিনা খানকে একই রুমে বসবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যৌবনে তাহমিনা খানও ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। ভাল ছাত্রী, ভাল বাংলা গদ্য লিখতেন এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। সবকিছু মিলিয়ে তার আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল। তিনি নিজের সম্পর্কে যা ভাবতেন, অন্যদেরও সেরকম ভাবতে বাধ্য করাতে পারতেন। কারণ তার চরিত্রের তেজ এবং দৃঢ়তা দুই-ই ছিল। কিন্তু তারপরেও একটা পাগলামো ভাব তার মধ্যে বরাবর ছিল। সেটা একটুও বেমানান ছিল না। প্রতিভাময়ী, সুন্দরী এবং ধনী বাবার মেয়েদের এরকম একআধটু পাগলামো থাকলে খারাপ তো দেখায় না, বরং সেটাকেই বাড়তি গুণ হিসেবে বিবেচনার মধ্যে ধরা হয়। মধ্য বয়সে এসে তাহমিনা ম্যাডামের সৌন্দর্যের দীপ্তি ম্লান হয়ে এসেছে, যৌবনে ভাটা পড়েছে কিন্তু পাগলামোর পরিমাণ কমে নি ।
শামারোখ এবং তাহমিনা খানকে যখন একই রুমে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো, আমরা তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটা করে ছোটখাট দুর্ঘটনার সংবাদ পেতে আরম্ভ করলাম । দুজনের মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ চলতে থাকল। দোষ কার সে বিচারের চাইতেও দুই সুন্দরীর মধ্যবর্তী বিরোধের সংবাদ সবাই আনন্দসহকারে উপভোগ করছিলেন। শামারোখ এবং তাহমিনা খান দুজনের কেউ হারবার পাত্রী নন। দুজনে দুদিক দিয়ে শক্তিমান। তাহমিনার রয়েছে প্রতিষ্ঠা। আর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি প্রফেসর হয়ে যাবেন। শামারোখের চাকরিটি এডহক বেসিসে হলেও তার শরীরে এখন ভরা যৌবন এবং বিবাহ-ছিন্ন কুমারী মহিলা। বেলা এগারটার সময় আমি তাহমিনা ম্যাডামের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, তিনি বসে বসে টিউটোরিয়ালের খাতা দেখছেন। এখনো শামারোখ আসে নি । আমি মনে করলাম, ভাল সময়ে আসা গেছে। শামারোখ আসার আগে তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যাবে । আমি সালাম দিলাম। ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অ জাহিদ, কি মনে করে বসো। আমি টাকাটা গুণে টেবিলে রেখে বললাম, ম্যাডাম টাকাটা দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তিনি খাতা দেখতে দেখতেই বললেন, আজকাল বুঝি তোমার অনেক টাকা, চাকরিবাকরি তো কর না, কোথায় পাও টাকা, কে দেয়? এই ম্যাডামটি এরকমই । আমি অপেক্ষা করছিলাম আগে ম্যাডামের রাগটা কমুক।
এই সময়ে ঘরে ঢুকল শামারোখ । আমাকে দেখেই বলে ফেলল, জাহিদ ভাই, কখন এসেছেন? এদিকে আসুন। তাহমিনা ম্যাডাম হাতের খাতাটা বন্ধ করে শামারোখের দিকে একটা অগ্নিময় দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, জাহিদ আমার এখানে এসেছে। ওখানে যাবে না। সে আমার ছাত্র। চুপ করে বসে থাক জাহিদ, একচুলও নড়বে না। শামারোখ গলার স্বর আরেকটু চড়িয়ে বলল, আপনার ছাত্র, তাতে কি? উনি এসেছেন আমার কাছে, জাহিদ ভাই এদিকে চলে আসুন। কি করব বুঝতে না পেরে আমি শুধু ঘেমে যাচ্ছিলাম। শামারোখ আমার একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, এদিকে চলে আসুন। অন্য হাতটা ধরে তাহমিনা ম্যাডাম বললেন, তোমাকে
নড়তেচড়তে নিষেধ করেছি। আমি কোন্দিকে যাই! ঠিক এই সময় একটা কাজ করে বসলাম আমি। এক ঝটকায় দুমহিলার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে জোরে হেঁটে একেবারে আর্টস বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে এলাম।
এই ঘটনাটি গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নানারকম শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে গেল, আমার মুখ দেখাবার উপায় রইল না। আসল ঘটনা যা ঘটেছিল এবং যা প্রচারিত হয়েছিল, দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। একদিন আমি ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়ির পাশে দিয়ে যখন হেঁটে আসছিলাম, আমার অপর শিক্ষিকা মিসেস রায়হানা হক বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছিলেন। এই একরোখা মহিলাকে আমি বাঘের চাইতে বেশি ভয় করি। তিনি আমাকে রাস্তার একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, আচ্ছা জাহিদ, তোমার লাজলজ্জার বালাই কি একেবারেই নেই? ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ এবং উল্টোপাল্টা কাহিনীর জন্ম দিচ্ছ। আরেকদিন যদি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের ধারেকাছে তোমাকে দেখি, তাহলে, সবার সামনে তোমাকে জুতোপেটা করে ছাড়ব। তখন তোমার শিক্ষা হবে। কথাগুলো বলে তিনি গট গট করে চলে গেলেন। আমার ইচ্ছে হলো দুহাতে মাথা ঢেকে সেখানে বসে পড়ি।