এই এখন নিজের মধ্যে হাজার চেষ্টা করেও আমি সেই মুগ্ধ আবেশ সৃষ্টি করতে পারি নে। শামারোখ যখন আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করল, আমি ভড়কে গেলাম। আমার যদি তাকে ধারণ করার ক্ষমতা থাকত, অবশ্যই আমি তাকে বিয়ে করতাম। শামারোখের মতো মূল্যবান শ্বেতহস্তী পুষব, আমার তেমন গোয়াল কোথায়? আমি যে তাকে বিয়ে করতে রাজি হই নি, এটা আমার একান্তই দুঃখ-বেদনা এবং লজ্জার বিষয়। তার আত্মমর্যাদাবোধ যাতে আহত না হয়, সে জন্য তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে চেষ্টা-তদবির করে তার কাজটি জুটিয়ে দিয়েছি, যাতে তার ভাল-মন্দের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করতে পারে এবং আমি একান্ত ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক দুঃখগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে পারি।
আমার মনে হচ্ছে শামায়োখ তার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা এভাবে দেখতে চেষ্টা করেছে। তার জীবনের এক দুর্বল মুহূর্তে তার জীবনের একান্ত লজ্জা এবং পরাজয়ের কাহিনী আমার কাছে প্রকাশ করেছে। এটা সে এই বিশ্বাসে করেছিল যে, শামারোখ ধরে নিয়েছিল তার ভাল, তার মন্দ সবকিছু জেনে আমি তাকে বিয়ে করব। তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে আমি তাকে যখন চাকরিটি পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করলাম এবং সেটা সে যখন পেয়ে গেল, শামারোখ ভাবতে আরম্ভ করেছে আমি তাকে করুণা করেছি। আমার কাছে সব চাইতে দুঃখের ব্যাপার হলো আমার এই সাহায্যটুকু সে বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে না। শামায়োখ তো আমাকে কম দেয় নি। এখন সে তার পথে যাক না কেন। তার তো কোনো কিছুর অভাব থাকার কথা নয়। মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রের ওপর একবিন্দু দখল না থাকা সত্ত্বেও আমি শামারোখের মনের গতিবিধি ‘ক্যাট’ মানে যেমন ‘বেড়াল’ সে-রকম প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে পারছি।
শামারোখ বিষয়টা খুব সম্ভবত এভাবেই চিন্তা করছে। সে আমাকে গোপন গহন লজ্জা এবং পরাজয়ের কথা বলেছে এবং গভীর আকাক্ষাটির কথাও প্রকাশ করে ফেলেছে। আমি তাকে একটা অবস্থানে দাঁড়াতে সাহায্যও করেছি। সুতরাং সে ধরে নিয়েছিল আঁচল-বাঁধা-চাবির মতো আমাকে নিজের হাতে রেখে দেয়ার অধিকার আছে তার। তারপরে যখন তার পছন্দ হবে না ইচ্ছেমতো প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতাটুকুও সে নিজের হাতেই রেখে দিতে চায়। আমি তার উপকার করেছি অথচ তার কাছে বাঁধা পড়ি নি এই জিনিসটাকে সে ব্যক্তিগত পরাজয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমি যদি ওই এলাকায় না থাকতাম, তার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হবার অবকাশ না থাকত, এ-ধরনের মর্জি ও মানসিকতা তার মধ্যে আদৌ জন্ম নিত কি না, সন্দেহ।
দুঃখের কথা হলো আমি এই এলাকায় বাস করছি, প্রতিদিন তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হচ্ছে এবং সে নিজের চোখে দেখছে নানা মহিলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তাদের কারো ঘরে বসে আলাপ করছি, কারো বাড়িতে যাচ্ছি। শামারোখ মনে করছে এই মহিলাদের কারো-না-কারো সঙ্গে আমার হৃদয়ের ব্যাপারস্যাপার আছে। আর এই কারণেই আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে আসার চেষ্টা করছি। শামায়োখ সঠিক ধরতে পারছে না কার সঙ্গে কি ধরনের সম্পর্ক আমার আছে এবং শোধ নেয়ার ঠিক ঠিক কর্মপন্থাটি গ্রহণ করতে পারছে না বলেই আমাকে ডানে-বামে আক্রমণ করার পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। সে জীবনে পরাজিত হয়েছে একথা আমার কাছে বলেছে। এখন মনে করতে আরম্ভ করেছে আমার কাছে তার আরেকটা পরাজয় হলো। যে সমস্ত মহিলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে তাদের কেউই কোনোদিক দিয়ে তার চাইতে যোগ্য নয়। শারীরিক সৌন্দর্যে বলুন, লেখাপড়ায় বলুন, রুচি এবং সুকুমার উপলব্ধিতে বলুন, এই মহিলাদের সবাই শামারোখের চাইতে খাট। সুতরাং একমাত্র শামারোখ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে আমার কোনোরকম সম্পর্ক থাকবে কেন? অবশ্য শামারোখের সঙ্গে অন্য পুরুষ মানুষের যদি সম্পর্ক হয়, সেটা মোটেই ধর্তব্যের নয়। কারণ শামায়োখ অপরূপ মহিলা। সুন্দরী গুণবতী নারীর প্রতি তো পুরুষ মানুষেরা আকৃষ্ট হবেই। এতে শামারোখের দোষ কোথায়? জ্বলন্ত আগুনে যে পোকারা ঝাঁপ দিয়ে মরে তাতে কি আগুনের অপরাধ আছে? কারণ পোকাদের ভাগ্যই আগুনে পুড়ে মরা। শামারোখকে সব দিক দিয়ে সেকালের রানীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। রানী কি মনের মধ্যে কোনো ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ লালন করে রানীগিরি টিকিয়ে রাখতে পারেন?
আমার দৃঢ় ধারণা, আমি যে তাকে সাহায্য করেছি এই ব্যাপারটিকে মানুষ করুণা এবং অনুকম্পাবশত যেমন পতিতা উদ্ধার করে কিংবা দুঃস্থ মহিলাদের সমাজে পুনর্বাসিত করে, সেভাবে সে বিচার করছে। শামারোখ পতিতা নয়, দুঃস্থাও নয়। অথচ আমি যখন অন্য মহিলাদের সঙ্গে আলাপসালাপ করছি, তীক্ষ্ণ মর্মবেদনায় অনুভব করছে, আমি তাকে করুণার পাত্রী হিসেবে দেখছি। এখানেই হলো সমস্ত গণ্ডগোলের উৎস। একদিনের একটি ঘটনার কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রেরা কি একটা ব্যাপারে হরতাল ডেকেছে। গোলাগুলির আশঙ্কায় ছাত্র-ছাত্রীদের বেশির ভাগই সকাল সকাল ঘরে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে ফাঁকা। আমি জহরত আরার কাছে একটি ধার-করা বই ফেরত দিতে গিয়েছি। জহরত আরার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি অন্য একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে দেখে বললেন, জাহিদ, তুমি একটু বাইরে অপেক্ষা কর। আমি তখন জহরত আরার ঘরের সামনে সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়ালে নোটিশ বোর্ড দেখছি। নোটিশ বোর্ডে কি দেখব আমি? আসলে সময়টা পার করছিলাম মাত্র। হঠাৎ পিঠে কার হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি শামারোখ। শামারোখ আমাকে এভাবে আবিষ্কার করবে আমি ভাবতে পারি নি। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? আমি বললাম, আপার কাছ থেকে একটা বই ধার করেছিলাম, ফেরত দিতে এসেছি। শামারোখ বলল, টসটসে রসগোল্লার মতো রাক্ষুসী মহিলাদের কাছে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আপনার কি কোনো কাজ নেই? লাজলজ্জাও আপনার কম। সে সময়ে জহরত আরা তার মহিলা অতিথিকে বিদেয় দিতে ঘরের বাইরে এসেছিলেন। কথাগুলো তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। হে ধরণী দ্বিধা হও- মনে মনে উচ্চারণ করলাম।