জহরত আরাকে সুন্দরী বলা ঠিক হবে না। তিনি ছিলেন বেঁটেখাট ধরনের। মুখের ছিরিছাঁদও বিশেষ ছিল না। মুখখানা ছিল মঙ্গোলীয় ধাঁচের। কিন্তু নাকটা মঙ্গোলীয়দের মতো চ্যাপ্টা ছিল না, স্বাবলম্বী দৃঢ়চিত্তের মহিলাদের মধ্যে যেমন মাঝে মাঝে দেখা যায়, তার নাকের নিচে খুব ভাল করে তাকিয়ে দেখলে সূক্ষ্ম একটা অবিকশিত গোঁফের রেখা লক্ষ্য করা যায়। তিনি মাথার ঠিক মাঝখানটিতে সিঁথি কেটে চুলগুলো পেছনে নিয়ে জোর করে খোঁপা বাঁধতেন। হাঁটার সময়ে দোদুল খোঁপাটা কেঁপে কেঁপে উঠত। তার মাথায় চুল ছিল অঢেল। কানের গোড়ার দিকে কয়েকটি পাকা চুলের আভাসও দেখা যেত। তিনি যখন হাঁটতেন, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতেন। এ সময়ে দোদুল খোঁপাটা দুলে দুলে উঠত। তার পরনের শাড়ি, পায়ের জুতো, চলার ভঙ্গি সবকিছু গাম্ভীর্যের কঠোর অনুশাসন মেনে চলত। জহরত আরার গায়ের রঙ ছিল মাজা মাজা, সাদাও বলা যেতে পারে। কাঁধের পিঠের যে অংশ দেখা যেত, তার থেকে কোনো জৌলুস ঠিকরে বোরোতো, একথা মোটেও বলা যাবে না। জহরত আরাকে সুন্দরী কিংবা অসুন্দরী এই অভিধায় ফেলে বিচার করা যাবে না। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এক ধাতুতে গড়া প্রতিমার মতো- সবটাই জহরত আরা- সবটাই ব্যক্তিত্ব।
জহরত আরার এই যে একাকীত্ব এবং অটল ব্যক্তিত্ব, সেটাই আমাকে তার কাছে টেনে নিয়ে যেত। তিনি ঠোঁটকাটা স্বভাবের মহিলা ছিলেন। যেদিন হাতে কাজ থাকত মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতেন, হাতে খুব কাজ, বসতে বলতে পারব না। আজ তুমি এসো। যেদিন মহিলার সময় থাকত, থুতনিতে মাথা রেখে চুপচাপ আমার কথা শুনে যেতেন। তিনি শুধু মাঝে মাঝে হুঁ-হাঁ করতেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর যখন বেরিয়ে আসতাম, মহিলার সঙ্গে কি বিষয়ে কথা বলেছি, একদম মনে করতে পারতাম না। নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, তাহলে এতক্ষণ কি বকবক করলাম!
জহরত আরার কাছে এই যে যাওয়া-আসা করছি, তার পেছনে কোনো গূঢ় কারণ আছে কি না, নিজের কাছেও জিজ্ঞেস করতে পারি নি। আসলে জহরত আরার কাছে আমি কেন যাই? সাদা কথায় ভাল লাগে বলেই যাই। কেন ভাল লাগে কখনো ভেবে দেখি নি, কারণ ভেবে দেখার সাহস হয় নি।
শামারোখ খুব সহজে যখন পেয়ারের জহরত আরা শব্দটি বলে ফেলল আমার সচকিত না হয়ে উপায় রইল না। আ য উঠি-উঠি করছিলাম, বসে পড়লাম। মহিলা আমার মনের গহনের এমন একটা জায়গায় ঘা দিয়ে বসে আছে, যা আমি অত্যন্ত নির্জন গোপন মুহূর্তেও উচ্চারণ করতে সাহস পাই নি, পাছে বাতাস বিশ্বাসঘাতকতা করে। মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে এনে বললাম, অনেকের কথাই তো বললেন, জহরত আরা বাকি থাকবে কেন? শামারোখ হাসতে হাসতে বলল, জানেন জাহিদ ভাই, আপনার পেয়ারের জহরত আরা যখন শাড়ির গোছাটা হাতে ধরে থপ থপ করে হেঁটে যায়, অবিকল একটা বাচ্চা হাতির মতো দেখায়। আমার খুব শখ হয়, এক জোড়া গোঁফ কিনে মহিলার মুখে লাগিয়ে দিই। একেবারে বেঁটেখাট নেপালির মতো দেখাবে। এইরকম একজন মেয়ে মানুষ, যার যেখানে মাথা, সেখানে চোখ, যেখানে গাল, সেখানে নাক-মুখ-ঠোঁট, এমন একটি বদসুরত মেয়েমানুষের সঙ্গে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান কেমন করে?
খুব কষ্টে হেসে বললাম, খুব ভাল বলেছেন, বাকিটা আরেকদিন শুনব, এখন যাব।
শামারোখ বলল, খুব লেগেছে না!
আমি বললাম, লাগবে কেন?
.
১৯.
মনস্তত্ত্ব জিনিসটাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। যেসব মানুষ মনস্তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করে পারতপক্ষে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করি। আমার মনে হয়েছে মনস্তত্ত্বের কারবারীরা নিজেরাই মানসিক রোগী। তাদের সঙ্গে বেশি ঘাটাপিটা করলে অন্যকেও তারা রোগীতে পরিণত না করে ছাড়ে না। একটি মানুষের কত অংশ মন? তার তো শরীর আছে, শরীরের শরীরসমাজ আছে। সবকিছু বাদ দিয়ে মন নিয়ে টানাটানি করলে যে জিনিসটা বেরিয়ে আসে, সেটা শূন্য। পেঁয়াজের খোসার পর খোসা উন্মোচন করতে করতে একেবারে শেষে কি থাকে, কিছুই না। এগুলো একজন আনাড়ির কথা। মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রের ওপর মতামত দেয়ার ক্ষমতা আমার থাকবে কেন? আমি শুধু নিজের মনোভাবটুকু প্রকাশ করলাম।
শামারোখের পাল্লায় পড়ে, এখন টের পেতে আরম্ভ করেছি, আমার ভেতর থেকে মনস্তত্ব উঁকি মারতে আরম্ভ করেছে। আমি এই অক্টোপাশের থাবা এড়িয়ে যেতে পারছি নে। শামায়োখ কখন কি কাজ কোন্ উদ্দেশ্যে করে, দাবার বোড়ের মতো একটার পর একটা চাল আমাকে সামনে রেখে যেভাবে প্রয়োগ করে তার ভেতরের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারি। আমি শামারোখের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না। মায় নে কমলিকো ছোড়নে মাংতা, মাগার কমলি নে হামকো নেহি ছোড়। উয়ো কমলি নেহি ভালুক হ্যায়। আমি শামায়োখের বিষয়টা আমার তরফ থেকে যেভাবে চিন্তা করেছি, সেটা খুলে বলি। তাকে আমি তীব্রভাবে পছন্দ করেছি। এমন একটা সময়ও ছিল, যদি শামারোখ বলত, জাহিদ, তুমি পাঁচতলা থেকে লাফ দাও, আমি লাফ দিতাম। যদি বলত, তুমি ছুটন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ো, আমি একটি কথাও না বলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। যদি বলত, তুমি আমার গৃহভৃত্য হিসেবে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে, আমি নির্বিবাদে গৃহভৃত্যের অবস্থান কবুল করে নিতাম। কিন্তু শামারোখের সে ধরনের সরল আত্মোৎসর্গের প্রয়োজন ছিল না। তার প্রেমে অন্ধ হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে তীক্ষ্ণধার ছুরি দিয়ে হৃৎপিণ্ড কেটে তার পায়ের তলে অর্ঘ্য দেবে, সেটা শামারোখের কামনা ছিল না এবং সেজন্য এখনো আমি বেঁচে রয়েছি।