প্রায় মাসখানেক পরে একদিন শামারোখ আমাকে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল । এই সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে এক-আধবার দেখা হয়েছে, তবে বিশেষ কথা হয় নি। যতবারই দেখা হয়েছে, বলেছে, খাটতে খাটতে তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্লাস করা, টিউটোরিয়াল দেখা, সিলেবাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিদিন নতুন করে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন চাকরি পেলে মানুষ নিজের গুরুত্ব জাহির করার জন্য লম্বা-চওড়া যেসব বোলচাল ঝাড়ে, শামারোখকেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না। কিন্তু তার অসহায়ত্ববোধটা কেটে গেছে। আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সে কথাবার্তা বলছে।
শামারোখ জানালো আজ সে প্রথম মাসের মাইনে পেয়েছে। তাই আমাকে খেতে ডেকেছে। খেতে খেতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতসব খবরাখবর বলতে থাকল শুনে আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। মাত্র একমাস সময়ের মধ্যে শামারোখ এতসব সংবাদ সংগ্রহ করল কেমন করে? আমি এই এলাকায় দশ বছরেরও বেশি সময় বসবাস করছি, অথচ তার এক-দশমাংশ খবরও জানি নে। কোন শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে নষ্টামি-ফস্টামি করে বেড়ায়, কোন্ শিক্ষক বউকে ধরে পেটায়, কোন্ শিক্ষক বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে অকর্ম-কুকর্ম করে, কোন্ শিক্ষকের মেয়েকে স্বামী তালাক দিতে বাধ্য হয়েছে, কোন শিক্ষক জাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমোশন আদায় করেছে- সব খবর তার নখদর্পণে। এক কথায় শামারোখ বিশ্ববিদ্যালয়ের যত আধিব্যাধি আছে, তার এক সরস বর্ণনা দিল।
এরই মধ্যে খাওয়া শেষ হয়ে এল। খাওয়ার পর চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে মহিলা শিক্ষকদের সম্বন্ধে তার পর্যবেক্ষণের ফলাফলগুলো প্রকাশ করতে থাকল। ইতিহাসের হামিদা বানু এত জাহাবাজ মহিলা যে স্বামী বেচারাকে আলাদা বাসা করে থাকতে হয়। অর্থনীতির জিন্নাতুন্নেসা আসলে থুথুরে বুড়ি, অথচ এমন সাজগোজ করে এবং এত রঙচঙ মাখে দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। সাইকোলজির ফাহমিদা বেগমের ঘাড়টা জিরাফের মতো, অথচ ভণ্ডামি কত, মনে করে সে সবচাইতে সুন্দরী। কোদালের মতো দাঁত বের করে এমনভাবে হাসে দেখলে চোপাটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। শামারোখের সব রাগ দেখা গেল পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের জেবুন্নেসার ওপর। মহিলা হাইহিলে খুট খুট করে এমনভাবে আসে যেন মাটিতে তার পা পড়ছে না। আর এমন নাসিক্য উচ্চারণে কথাবার্তা বলে যেন এক্ষুনি এয়ারপোর্ট থেকে নেমেছে, এখনো লাগেজ-পত্র এসে পৌঁছায় নি। তারপর শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে মহিলা কিভাবে হাঁটেন, অনুকরণ করে দেখালো । আমি বললাম, আপনার মহামূল্যবান অভিজ্ঞতার কথা আরেকদিন শোনা যাবে। আজ একটু কাজ আছে। শামারোখ বলল, আরে বসুন। এখন কি যাবেন। আমি বললাম, আপনাকে তো বলেছি, আমার একটা কাজ আছে। সে বলল, কাজ তো আপনার সব সময় থাকে। তার আগে আপনার পেয়ারের জহরত আরার কথা শুনে যান।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো, নিজের হাতে ছিপি খুলে আরব্যপোন্যাসের জীবনটা মুক্ত করে দিয়েছি। এই তো সবে শুরু, সামনে আরো কত দেখতে হবে, কে জানে! এই মহিলার মেটাল ডিটেক্ট করার মতো একটা আলাদা ক্ষমতা আছে। প্রথম দৃষ্টিতেই কার কোথায় খুঁত আছে চট করে ধরতে পারে। একটা কথা ভেবে আমি অবাক না হয়ে পরলাম না। শামারোখের তো নানাবিধ গুণ রয়েছে। সেগুলোর পরিশীলন করার বদলে মানুষের খুঁত আবিষ্কার করার কাজে এমন তৎপর হয়ে উঠবে কেন? আরো একটা কথা ভেবে শঙ্কিত হলাম যে জহরত আরার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করল কেমন করে? তার দৃষ্টি থেকে কিছুই কি এড়াতে পারে না?
জহরত আরা বয়সে আমার সামান্য বড় হবেন। অ্যানথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করেন। অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলেন। দেশের মধ্যে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথায় কি ঘটছে জানেন বলে মনে হয় না। অথবা জানলেও সেগুলোর মধ্যে জড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্রও নেই। মহিলা সব ধরনের ভজকট ব্যাপার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন। গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটান। সব সময় দেখেছি মোটা মোটা খামে দেশের বাইরে টাইপ করা চিঠি পাঠাচ্ছেন। সব সময় রুমের মধ্যে আটক থাকেন। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে লাউঞ্জে এসে হাসানাত সাহেবের সঙ্গে এক কাপ চা খান। পনের-বিশ মিনিট লাউঞ্জে কাটিয়ে বাড়ি চলে যান। জহরত আরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী থাকার সময় থেকেই হাসানাত সাহেবের প্রিয় ছাত্রী। হাসানাত সাহেবের বয়স যদি সত্তর না হতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের যা পরিবেশ জহরত আরার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে নানারকম মুখরোচক গল্পের সৃষ্টি হতে পারত। তার কারণ জহরত আরা নিজেও বিয়ে করেন নি । কেন বিয়ে করেন নি, সেই সংবাদটিও কেউ বিশদ করে বলতে পারে না। এমনকি ডিপার্টমেন্টের যেসব মহিলা সহকর্মী, যারা জহরত আরাকে রীতিমতো অপছন্দ করেন, তারাও না। জহরত আরা কারো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কুমারী জীবন যাপন করছেন, কিংবা কারো প্রতীক্ষায় এমন একলা-একা জীবন কাটাচ্ছেন, সে খবর যদি জানা সম্ভব হতো, আমার ধারণা, অবশ্য অবশ্যই শামারোখের স্বয়ংক্রিয় মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ে যেত।
চলাফেরা করার সময় জহরত আরার চারপাশে একটা গাম্ভীর্য বেষ্টন করে থাকে। সেটা ভেদ করে তার কাছাকাছি পৌঁছুনো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। আমি যদি সাহস করে বলি, জহরত আরার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ আমার ঘটেছিল, তাহলে খুব সম্ভবত মিথ্যে বলব না। ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হাসানাত সাহেব । অমি তাকে আমার লেখা একটা বই পড়তে দিয়েছিলাম। এই নাক উঁচু স্বভাবের ভদ্রমহিলা, যার কাছে দেশের সবকিছু তুচ্ছ অথবা চলনসই, মন্তব্য জানতে চেয়ে পড়তে দিয়েছিলাম। তিনি দুদিন পর তার ডিপার্টমেন্টের পিয়ন দিয়ে আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, য়ু আর এ্যাপ্রোচিং গ্রেটনেস। তারপর থেকে ফাঁক পেলেই মহিলার ঘরে যেতাম। তিনি আমাকে কোনোদিন ডাকেন নি । অথচ আমি যেতাম। কখনো তার গাম্ভীর্যের আবরণ টলেছে এমন আমার মনে হয় নি। আমি ধরে নিয়েছিলাম, যে মানুষ গ্রেটনেসের পথে পা বাড়িয়েছে, তার এই গাম্ভীর্যের আবরণটুকু কেয়ার না করলেও চলে। মহিলা একদিনও আমাকে চলে আসতে বলেন নি।