এতক্ষণ ভদ্রমহিলা একটি কথাও বলেন নি। দাঁড়িয়ে আমাদের বিতর্ক শুনছিলেন। এইবার তিনি হঠাৎ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একখানা ছুরি বের করে স্প্রিংয়ে চাপ দিলেন। সাঁই করে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি ফলা বেরিয়ে ঝকঝক করতে লাগল। দারোয়ানকে বললেন, এই বুড়া মিয়া, দেখছ এটা কি? সরে দাঁড়াও। নইলে বুকের মধ্যে বসিয়ে দেব। দারোয়ানের মুখ থেকে ‘ও বাবারে’ শব্দটা আপনিই বেরিয়ে এল এবং তার শরীর ভয়ে শিউরে উঠল। হাফিজ মিয়া শক্ত ধাচের মানুষ। একটা মেয়ে মানুষ ছুরি দেখিয়ে ভেতরে ঢুকবে, তা কেমন করে হয়? তাহলে দারোয়ান হিশেবে তার মানসম্মানের কিছুই থাকে না। অল্পক্ষণের মধ্যে সামনে এগিয়ে গিয়ে দ্বিগুণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আপনি ছুরি মারবার চান মারেন মেমছাব, আমি আপনেরে ভেতরে যাইবার দিমু না। এই কথা শোনার পর দুরদানা ছুরি বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর দারোয়ানের একটা হাত ধরে এমনভাবে টান দিল বেচারি একপাশে ছিটকে পড়ে গেল। মহিলা সেদিকে একবারও না তাকিয়ে বললেন, জাহিদ সাহেব, চলুন আপনার ঘরটা দেখে যাই। আমি মহিলার শরীরের জোর দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্মৃতিকণা তাহলে তার সম্পর্কে একটা কথাও বাড়িয়ে বলে নি। হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে গেলাম। দারোয়ানের নিষেধ ঠেলে ভদ্রমহিলা তো আমার ঘরে এলেন। যাইহোক, এই ঘটনার জের অনেক দূর গড়িয়েছিল। দারোয়ান রেগেমেগে ওয়ার্ডেনের কাছে নালিশ করেছিল। আইন লঙ্ন করা হয়েছে, তাতে কিছু আসে যায় না। একটা আওরত শরীরের শক্তি খাঁটিয়ে তাকে এমন নাজেহাল করতে পারে, সেই জিনিসটিই হজম করতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। চাকরি ছেড়ে দেবে এমন ঘোষণাও সে দিয়েছিল। সেদিনই বিকেলবেলা ওয়ার্ডেন আমার কাছে নোটিশ পাঠিয়ে জানালেন, আমাকে পত্রপাঠ তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমাদের হোস্টেলের ওয়ার্ডেন দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু ভেতরটা ছিল একেবারে ফাঁকা। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি বাংলায় লিখতে তাকে তিনবার ডিকশনারি দেখতে হতো। মাতৃভাষায় যার এমন অগাধ জ্ঞান, বিদেশী ছাত্রদের কাছে ইংরেজিতে চিঠিপত্র লিখে কি করে প্রশাসন চালাতেন এবং চাকরি টিকিয়ে রাখতেন, সে কথা তিনি এবং তার আল্লা বলতে পারবেন। আমি বিকেল পাঁচটায় ওয়ার্ডেনের অফিসে গেলাম। তিনি আমাকে দেখামাত্রই ক্ষেপে উঠলেন, জাহিদ সাহেব, আপনি হোস্টেলে এসব কী শুরু করেছেন?
আমি বললাম, কী শুরু করেছি আপনিই বলুন! তিনি বললেন, এই হোস্টেলের রেসিডেন্ট হিসেবে আপনারই জানা উচিত এখানে কোনো মহিলার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। অথচ হোস্টেলের আইন ভেঙে একজন মহিলাকে আপনার রুমে নিয়ে গিয়েছেন। দারোয়ান বাধা দিলে, তাকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। আপনি তো আর ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র নন। হোস্টেলের বোর্ডার হিসেবে নিয়ম-কানুন আপনার জানা থাকা উচিত।
আমি বললাম, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন, আমি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র নই। এখন একটা বিষয় আপনার কাছে জানতে চাইব। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের কাছে মহিলাদের যাওয়া-আসায় কোনো বাধা নেই। আমার ছাত্র জীবন শেষ হয়েছে অনেক আগে। আমার রুমে যদি একজন মহিলা আসেন, তাতে বাধা দেয়া হয়, তার কারণ কি?
ওয়ার্ডেন আবদুল মতিন বললেন, সে কথা আপনি ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই আইন করে হোস্টেলে মহিলাদের প্রবেশ বন্ধ করেছেন। আমার কাজ হোস্টেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
আমি জবাবে বললাম, ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কৈফিয়ত আমি তাকে দেব। তিনি বললেন, তাহলে ব্যাপারটা আপনি ভি. সি স্যারকে জানাতে বলেন? আমি বললাম, আপনার যাকে ইচ্ছে জানাতে পারেন। তারপর চলে এসেছিলাম।
তারপর থেকে দুরদানা আমার হোস্টেলে আসা-যাওয়া করতে থাকে। কেউ কিছু বলে নি। এমনকি দারোয়ান হাফিজের সঙ্গেও দুরদানা একটা ভাল সম্পর্ক করে নিয়েছে। কিভাবে সেটা সম্ভব হয়েছে, আমি ঠিক বলতে পারব না। সে এসেই জিজ্ঞেস করে, কি বুড়ামিয়া কেমন আছেন? হাফিজ একগাল হেসে জবাব দেয়, মেম ছাব, ভালই। হাফিজ পরিদর্শনের খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মেম ছাব, এইখানে আপনার একটা সাইন লাগান। দুরদানা আসার পর থেকে অন্য বোর্ডারদের রুমেও মহিলাদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে যায়।
মহিলাদের হোস্টেলে আসার বিধিনিষেধ উঠে গেল এবং সে সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগালেন স্বয়ং ওয়ার্ডেন আবদুল মতিন। কিছুদিন পর তিনি দেশের বাড়িতে গেলেন এবং এক মহিলাসহ ফিরে এলেন। পরিচয় দিলেন তার স্ত্রী বলে। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের তার নিজের রুমটিতে তারা স্বামী-স্ত্রী একই সঙ্গে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। কিছুদিন পর বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ পুলিশ এসে আবদুল মতিন এবং তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। তখনই আমরা আসল ঘটনাটা জানতে পারলাম। ওয়ার্ডেন স্ত্রীর পরিচয়ে যে মহিলার সঙ্গে বসবাস করছিলেন,সে মহিলা তার বিয়ে করা স্ত্রী নয়। তার এক মামাতো না ফুপাতো ভাই দুবাই কি কুয়েত নাকি সৌদি আরবে থাকত, ভায়ের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মতিন তার বউটিকে ফুসলিয়ে এনে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে হোস্টেলে একই সঙ্গে বসবাস করছিলেন। জ্ঞাতিভ্রাতা ফিরে এসে মামলা করলে পুলিশ তাদের দুজনকে গ্রেফতার করে। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের ভাগ্যই এমন, ওয়ার্ডেন হিশেবে যারাই এখানে আসেন, একটা-না-একটা যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাবেনই।