আরো একটি কারণে আমি একটুখানি আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিলাম। সেই বিষয়টি বয়ান করি। শামারোখ আমার ঘরে এসে জানিয়েছে, আমি যেন তাকে বিয়ে করি। এটা একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক প্রস্তাব নয় । চোরের ভয়ে মানুষ যেমন এরন্ডা হাতে নেয়, শামারোখের বিয়ের প্রস্তাবটিও অনেকটা সেরকম। চারপাশ থেকে ধাক্কা খেয়ে মানুষ হাতের কাছে যাকে পায়, অবলম্বন করে বাঁচতে চেষ্টা করে, তেমনি শামারেখও আমাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে দাঁড়াবার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করছে। আমি তাকে দাঁড় করাতে পারব না; বরং নিজেই তলিয়ে যাব। তাছাড়া আরো একটি কথা, শামারোখ আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে, একথা সত্যি বটে। তার আকর্ষণ করার সমস্ত উপাদান আছে। আমি যেমন আকর্ষণ বোধ করি, সেরকম তাকে যে-ই দেখে সবাই একইভাবে তার দিকে ঢলে পড়ে। অনেকদিন একসঙ্গে চলাফেরার পর আমার মনে এরকম একটি ধারণা জন্মেছে, শামারোখ জলসা ঘরের ঝাড় লণ্ঠনের মতো একজন মহিলা। একসঙ্গে অনেক মানুষের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়ার জন্যই তার সৃষ্টি হয়েছে। মোমের আলোর ক্ষীণ যে শিখা তার আলোয় একজন মানুষ তার ভেতরটা উপলব্ধি করতে পারে, শামারোখ সে রকম কেউ নয়। সে মানুষকে তার আপন অস্তিত্বই ভুলিয়ে দেয়। এই মহিলার মধ্যে একান্ত গোপনীয়, একজন ব্যক্তি যেখানে তার আপন স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে, সেরকম কোনো বস্তুর সন্ধান আমি পাই নি ।
তারপরেও কথা থেকে যায়। শামারোখের শারীরিক সৌন্দর্য, শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ, সরল-সহজ ব্যবহার এবং সহজাত সম্মানবোধ একজন মাত্র মহিলার মধ্যে এই এতগুলো গুণের সমাবেশ জন্মের পর থেকে আমি কোথাও দেখি নি । এই রকম একজন মহিলা যখন আমার কাছে এসে অবলীলায় বলতে পারে, তুমি আমাকে উদ্ধার কর । আপাতত বিয়ে করাই হচ্ছে উদ্ধারের একমাত্র পথ। আমি তার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তার আত্মসম্মানবোধ যে জখম করি নি, সে জন্য নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার অনেকখানিই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করছে, এমন একজন অসহায় মহিলাকে যে তার নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে পারলাম, এই জিনিসটি আমার কাছে হিমালয়ের উচ্চতম শৃঙ্গে আরোহণের চাইতেও বেশি গৌরবের কাজ বলে মনে হলো। এখন শামারোখ ইচ্ছে করলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। সেই সুযোগটি আমি নিজেই তৈরি করে দিয়েছি। সুন্দর বস্তু পশুদের পায়ের তলায় পিষ্ট হতে দেখে বেদনা আমি অনুভব করে থাকি। আমি ধরে নিলাম, শামারোখের পায়ের তলার মাটিটির ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি সুন্দরের মান রক্ষা করলাম।
দুতিন দিন বাদে শিক্ষকদের লাউঞ্জে গিয়ে আমি মনে মনে মস্তরকম একটা চোট খেয়ে গেলাম। শামারোখের জন্য লড়াই করার পেছনে আমার ব্যক্তিক অহং কাজ করে নি, সে কথাটা সত্যি নয়। তারপরেও ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের মধ্যে যে বিরোধ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মধ্যে মানবিক মহত্ত্ববোধ প্রতিষ্ঠার মধ্যে যে একটি পৌরুষ রয়েছে, সেটাই আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম । লাউঞ্জে গিয়ে দেখলাম ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর টেবিলের উল্টোদিকে বসে শামারোখ হেসে হেসে তার সঙ্গে খোশ-গল্প করছে। আমার চট করে মনে হলো, সকলের সংগঠিত প্রতিরোধের মুখে শামারোখের চাকরিটি পাইয়ে দিয়ে আমি শুধু একটি মামলা জিতেছি মাত্র। মামলার পাল্টা মামলা আছে। আপিল আছে। আপিলের ওপর আপিল আছে। যে সমস্ত মহৎ অনুষঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে আমি মনে মনে অহংকারে স্ফীত হয়ে উঠছিলাম, তার সঙ্গে এই চাকরি পাওয়ার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। এটা নেহায়েতই একটা মামুলি ব্যাপার ।
শামারোখ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেই বুঝে গেছে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী এবং তার দলের লোকদের সঙ্গেই তাকে কাজ করতে হবে। সুতরাং জয়েন করেই তার প্রথম কাজ দাঁড়িয়ে গেছে, তাকে চাকরি পেতে যারা বাধা দিয়েছিলেন তাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করা। তাদের অমতে শামারোখ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে পারলেও তারা যদি বেঁকে বসেন, তাহলে তার পক্ষে নিরাপদে কাজ করে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার প্রথম কাজ। আমি কোণার টেবিলে বসে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে শামারোখের টুকরোটাকরা আলাপ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রতি কথায় সে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর দিকে তার পদ্মপলাশ চোখ দুটো এমনভাবে মেলে ধরছিল, আমার মনে হচ্ছিল, একমাত্র এই মানুষটাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য নিয়ে শামারোখ জন্ম নিয়েছে। বুঝতে আমার কালবিলম্ব হলো না আমি জিতেও হেরে গেছি। এই ভণ্ড লোকদের সংঘবদ্ধ একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার প্রয়োজনে কত রকম হিল্লিদিল্লি করে শামারোখের এখানে আসার ব্যবস্থা করলাম। এখন শামারোখ নিজেও এই দুষ্টচক্রের একটি খুচরো যন্ত্রাংশে পরিণত হতে যাচ্ছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগল। সারা জীবন আমি আমার মেধা-প্রতিভা-শ্রম-সময় ভুল কাজে ব্যয় করে গেলাম । শামারোখকে যখন ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে হবে, তাকে ঝাকের কই হয়ে ঝাকের সঙ্গেই মিশে থাকতে হবে । শামারোখের মধ্যে একটি শিকারি স্বভাব আছে আমি জানতাম। তাকে এইখানে যখন কাজ করতে হবে, তখন সবচেয়ে প্রবল প্রতিপক্ষটিকে তার সৌন্দর্যের অস্ত্রে ঘায়েল করে কাবু করতেই হবে। শামারোখ তার ডিপার্টমেন্টের লোকদের সঙ্গে পানিতে চিনির মতো মিশে যাবে। অথচ আমি সকলের শত্রু হয়ে রইলাম। খেলার এটাই নিয়ম। আমি ওই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও দূরেটুরে চলে যেতে পারলে সবচাইতে ভাল হতো। কিন্তু সেটাই সম্ভব হচ্ছে না। আমার আশঙ্কা মিথ্যে হবে না, যে আগুন আমি জ্বালিয়ে তুলেছি, তার তাপ আমার শরীরে এসে লাগবেই।