আমি আর শামারোখ পরস্পর চকিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। তাহলে তিনি কি শামারোখের চাকরির বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করেন নি? দিলদার সাহেবের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। তিনি মুহূর্তেই আমার মনোভাবটা আঁচ করে নিলেন, না না তোমাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর যত অপূর্ণতা থাকুক বন্ধু-বান্ধবদের ব্যাপারে তার মনে অঢেল মায়ামমতা। শামারোখের কথাটা সব খুলে বলার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিএস-কে দিয়ে ফোনে শরীফকে তলব করলেন। ধমকের চোটে শরীফের তো যায় যায় অবস্থা, শামারোখ তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। এক হপ্তার মধ্যে ওরা তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দেবে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর দিলদার সাহেব বর্তমান পরিস্থিতির ওপর যেসব কবিতা এবং গান লিখেছেন পড়ে শোনাতে লাগলেন। খাতার সমস্ত গান এবং কবিতা পড়া শেষ হয়ে গেলে শামারোখ বলল, আর লেখেন নি? দিলদার সাহেব বললেন, অনেক কিছু লিখেছি কিন্তু আজ আর শোনাবো না। তোমাদের তো ফেরত যেতে হবে। এ সমস্ত জায়গায় বেশি রাতে চলাফেরা করা ভয়ংকর বিপজ্জনক।
শামারোখ ডেইজির কাছ থেকে বিদায় নিতে ভেতরে গেল। এই ফাঁকে দিলদার সাহেব আমাকে বললেন, তোমার চাকরিবাকরির কিছু হলো? আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আশঙ্কার সুরে বললেন, তুমি সেই একই রকম থেকে যাচ্ছ, দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে, কিছু একটা করো। নয়তো ধরা খেয়ে যাবে। দেখছ না আমার অবস্থা। শামারোখ বেরিয়ে এসে বলল, আমি মাঝেমধ্যে যদি আপনার কাছে আসি, আপনি বিরক্ত হবেন? দিলদার সাহেব বললেন, মোটেই না। তোমার যখন ইচ্ছে হয়, চলে এসো। মুশকিল হলো, এতদূর আসবে কেমন করে? শামারোখ বলল, সে দায়িত্ব আমার।
শামারোখের কাছে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগ দেয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এল, সে দিনটাকে আমার বিশেষ বিজয়ের দিন বলে ধরে নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা আমাকে এতদিন যেভাবে করুণার পাত্র মনে করে এসেছেন, আমি সে রকম তুচ্ছ মানুষ নই। আমি প্রমাণ করে ছেড়েছি, একজন মহিলার বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত নীরব প্রতিরোধ আমি অকার্যকর করতে পেরেছি। শামারোখকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা, এই অসম্ভবকে শেষ পর্যন্ত আমিই সম্ভব করলাম । এই কাজটাই করতে গিয়ে আমাকে কত জায়গায় যে যেতে হয়েছে, আর কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। নীরব চেষ্টার ভেতর দিয়ে এরকম একজন অসহায় মহিলাকে জীবনে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করলাম, এই ঘটনাকে একটা অসমযুদ্ধে জয়লাভ করা ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারলাম না। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি এই রকম একটি বড় কাজ করার জন্য কেউ আমার তারিফ করবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি, সব্বাই আমার দিকে এমন একটা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন, আমি যেন যজ্ঞের-বেদিতে একটা অপবিত্র পশুর লাশ এনে ফেলে দিয়েছি। তারা বাধা দিয়েও শামারোখকে ঠেকাতে পারেন নি, সে জন্য তারা তাদের পরাজয়ের গ্লানিটা আরো তীব্র-তীক্ষভাবে অনুভব করছিলেন। এই জিনিসটাই আমার কাছে পরম উপভোগ্য মনে হচ্ছিল। মনে মনে বলছিলাম, ভেবে দেখুন, কেমন গোলটা দিলাম।
সেদিনই সন্ধ্যেবেলা একটা কাজ করে বসলাম। হাইকোর্টের মাজারের সামনে যে ফুলঅলা বসে, তার কাছ থেকে একটা জমকালো করবী ফুলের মালা কিনে আনলাম। তারপর ঘরে এসে ভাল করে জামা-কাপড় পরে নিলাম। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দু-হাতে সেই হলুদ করবী ফুলের মালাটা নিজের গলায় ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর আমাকে কেমন দেখায়, নানা ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাই দেখতে লাগলাম । যুদ্ধজয়ী বীরের সঙ্গে নিজের তুলনা করে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পেলাম। একাকী এই নীরব বিজয়োৎসব পালন করছি, কাজটা নিজের কাছেই একটু পরে আমার হাস্যকর মনে হলো। আবার ভালও লাগল। আমার নিজের কাজের মূল্য আছে, তার স্বীকৃতি অন্যেরা যদি দিতে কুণ্ঠিত হয়, আমি বসে থাকব কেন? কেউ না দেখুক, আমি তো নিজে আমাকে দেখছি। আমার ইচ্ছে হলো, এই অবস্থায় একবার ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী, একবার ড. মাহমুদ কবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তারা যদি জিজ্ঞেস করেন, জাহিদ আবার কি নতুন পাগলামো করলে, গলায় করবী ফুলের মালা কেন? আমি জবাব দেব, স্যার, আজই তো মালা পরার দিন । জানেন না শামারোখ আজ ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে কাজ করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে। অথচ বাস্তবে আমি ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে কোথাও গেলাম না। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অতিরিক্ত দুঃখ প্রকাশের মতো অতিরিক্ত আনন্দও মানুষকে ক্লান্ত করে ফেলে। তাই ক্লান্তিবশতই জামা কাপড় এবং গলায় মালা-পরা অবস্থাতেই বিছানার ওপর নিজের শরীরটা ছেড়ে দিলাম। দরজা বন্ধ করতেও ভুলে গেলাম ।
অধিক রাতে কামাল আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন। সবচেয়ে ভাল জামা-কাপড় পরা অবস্থাতেই গলায় মালা দোলানো দেখে কামাল জিজ্ঞেস করলেন, জাহিদ ভাই, আপনার হয়েছে কি? মনে হচ্ছে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি বললাম, জানেন না কামাল কি হয়েছে? কামাল বললেন, জানব কেমন করে, আজকাল আপনি তো কিছুই জানান না, সব কাজ একা-একাই করেন। আমি বললাম, আজ শামারোখ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে। আমার উত্তরে কামালের কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। কেবল বললেন, আমি ধরে নিয়েছিলাম, আপনি শামারোখকে সেজেগুজে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, কোনো কারণে বিয়েটি ভেঙে যাওয়ায় মনের দুঃখে আপনি ঘরে এসে লম্বা নিদ্রা দিচ্ছেন। যাক বিয়েটি যে করে ফেলেন নি, সে জন্য আপনাকে কংগ্রাচুলেট করব । কামালের এই ধরনের মন্তব্য শুনে চট করে আমার মনে পড়ে গেল, কোনো বিজয়ই নিরবচ্ছিন্ন বিজয় নয়। তার আরেকটি দিকও রয়েছে। সব বিজয়ের পেছনে একটি পরাজয় লুকিয়ে থাকে।