আমি বললাম, দিলদার সাহেব, আপনাকে কি একটা খবর দেয়ার জন্য ডেকেছেন। আপনি যেতে চান কি না, সেটা বলুন। এখন বারোটা বাজে। ওখানে পাঁচটার সময় না পৌঁছুতে পারলে বাড়ি খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে। শামায়োখ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বলল, হ্যাঁ যাব।
আমি বললাম, তাহলে আপনাকে চারটের সময় আমার হোস্টেলে আসতে হবে।
শামারোখ তাদের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে আসতে অনুরোধ করেছিল। আমি রাজি হই নি।
আমাদের ধারণা ছিল অনধিক সাড়ে ছ’টা নাগাদ আমরা দিলদার সাহেবের বাড়িতে পৌঁছব । এ-গলি,সে-গলি, তস্য গলি এবং তস্য গলির তস্য গলি ঘুরে ধান খেত পেরিয়ে পুকুরপাড়ে একতলা বাড়ি খুঁজে বের করতে সাড়ে সাতটা পার হয়ে গেল। আর আমরা যেই ঘরের ভেতরে পা দিয়েছি, অমনি কারেন্ট চলে গেল। জমাট বাঁধা ভুতুড়ে অন্ধকারের মধ্যে আমরা অসহায়বোধ করতে লাগলাম। দিলদার সাহেব হারিকেনটা জ্বালিয়ে একপাশে রেখে বললেন, আমি ধরে নিয়েছিলাম, আজ তোমরা আর আসছ না। ডেইজি সেই গানটাই বার বার শুনিয়ে দিচ্ছিল, কাঙাল হইলে ভবে কেউ তো জিগায় না। হারিকেনের স্বল্প আলোতে আমি ঘরের চেহারাটা জরিপ করতে থাকলাম। এক কোণে সাদাসিধে একখানা তক্তপোশ। তিন-চারটে চেয়ার এবং কেরোসিন কাঠের একটা টেবিল। খুব সাধারণ একটা আলনায় গুছিয়ে রাখা হয়েছে ডেইজির শাড়ি, পেটিকোট এইসব । এছাড়া ঘরে অন্য কোনো আসবাবপত্র নেই। ভদ্রলোককে আমি গত দশ বছর ধরে তার ধানমন্ডির তিনতলা বাড়িতে দেখে এসেছি। তার বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো যেসব ছবি ছিল, সেগুলোর মূল্যও এই বাজারে তিন-চার লাখ টাকার কম হবে না। এখন ডেইজিকে নিয়ে যে ঘরে থাকছেন, চেহারা দেখে মনে হলো, ধানমন্ডির বাড়ি থেকে একটা কুটোও তিনি নিয়ে আসেন নি। মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা আমার অনেক পরিমাণে বেড়ে গেল। ইচ্ছে করলে তিনি ডেইজির দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারতেন। দুর্বল মুহূর্তে তো মানুষ অনেক কিছুই করে! দায়িত্ব স্বীকার করে এরকম জঙ্গলে বসবাস করার এই যে সাহস, কজন মানুষ সেটা করতে পারে? অনেকে দিলদার সাহেবকে ভাল মানুষ বলবেন না। কিন্তু আমার চোখে তিনি একজন যথার্থ পুরুষ। মাঝে মাঝে হাঁপানির টানে তাকে ধনুকের মতো বেঁকে যেতে হয়। কিন্তু তিনি যখন সোজা হয়ে দাঁড়ান, তার চোখের ভেতর থেকে যে দীপ্তি বেরিয়ে আসে, দেখলে মনে হয়, ওই বয়সে, ওই শরীরে তিনি বনের হিংস্র সিংহের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত। তার ঠোঁট জোড়া পাতলা, দেখলে ঝুঁটি শালিকের কথা মনে পড়ে যায়। যখন কথা বলেন গলার স্বর গমগম করে বাজে।
আমাদের কথাবার্তা শুনে ডেইজি বেরিয়ে এল। হাসল আমাদের দুজনকে দেখে। ফুলের মতো স্নান সে হাসি। আমি প্রশ্ন করলাম, কেমন আছেন? সে মাথা একদিকে কাত করে বলল, ভাল। আমি ডেইজির সঙ্গে শামারোখকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ডেইজি শামারোখকে বলল, আপনি খুব সুন্দর। উনি, মানে দিলদার সাহেব, কয়েকদিন থেকে আপনার কথাই বলছেন শুধু। শামারোখ তার চিবুকটা স্পর্শ করে বলল, আপনিও কম সুন্দর নন। ডেইজি বলল, আপনারা গল্প করুন, আমি রান্নাটা শেষ করে আসি।
ডেইজির সঙ্গে দিলদার সাহেবের বয়সের তফাৎ কম করে হলেও চল্লিশ বছর । স্বভাবতই ডেইজির সঙ্গে এত বেশি বয়সের একজন মানুষের বিয়ে হবার কথা নয়। অর্থ-সম্পদের লোভে যে সে দিলদার সাহেবকে বিয়ে করে নি সে তা তাদের ঘরকন্নার ধরনধারণ এবং ঘরের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। এই অসমবয়সী দুটি নারী-পুরুষ পরস্পরের মধ্যে এমন কি অমৃতের সন্ধান পেয়েছে দুজন দুদিক থেকে এই চরম আত্মত্যাগ করতে পারে? নাকি দুজনই পরিস্থিতির শিকার! ডেইজি নিচে মাদুর পেতে খাবার সাজাচ্ছিল। দিলদার সাহেব এমন খোশ-মেজাজে কথা বলে যাচ্ছিলেন যেন তিনি পরম সুখে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন। মানুষটা এতটা দুর্ভোগের মধ্যেও এমন প্রাণ প্রাচুর্যে কিভাবে কথাবার্তা বলতে পারেন, সেটা আমার কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আমি হঠাৎ করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করলাম, দিলদার ভাই, আপনার গাড়ি তো এখানে আনতে পারেন না। রাখেন কোথায়? তিনি জবাব দিলেন, এগার নম্বরের পেছনে এক বন্ধুর গ্যারেজে রেখে বাকি পথটা রিকশায় চেপে চলে আসি। তারপর তিনি আহত স্বরে বলে ফেললেন, ধানমন্ডির বাড়ি থেকে একমাত্র ওই গাড়ি এবং কিছু কাপড়-চোপড় ছাড়া আর কিছুই আনা হয় নি। গাড়িটা না থাকলে খোঁড়া হয়ে ওই অন্ধকূপের মধ্যে পড়ে থাকতে হতো। তার এই একটা কথার ভেতর দিয়েই অনেক কথা বলা হয়ে গেল।
আমরা খেতে বসলাম। ডেইজি রাধে চমৎকার। ছোট মাছ, ঘন করে মুগের ডাল বাচ্চা মুরগির ঝোলসহ রান্না করেছে। সঙ্গে শসার সালাদ। আমরা আরাম করে খেতে থাকলাম। না খেতে পেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। চোর-ছ্যাঁচ্চোড়ে দেশ ভরে গেছে। স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হচ্ছে না। রাস্তা-ঘাটে ডাকাত, হাইজ্যাকারদের ভয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, এই দেশটা কোন্ রসাতলের দিকে যাচ্ছে আমি তো ভেবে ঠিক থাকতে পারি নে। গত পরশু প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে এক ভিন্নরকমের ছবি দেখলাম। অসংখ্য তদবির করার মানুষ । প্রধানমন্ত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের কথা শুনতে হচ্ছে। আমি হলে সব ব্যাটাকে গুলি করে দিতাম। আমার ইচ্ছে ছিল প্রধানমন্ত্রীকে আমার নিজের কথাটাও বলব, কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে আমার মনটা এমন বিগড়ে গেল যে, ঠিক করলাম, এ ধরনের মানুষদের কাছ থেকে আমি কোনো সুযোগ গ্রহণ করব না।