রুল করা দামি কাগজ। এক পাশে ফাঁক ফাঁক করে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে লেখা। শিটগুলো নাড়াচাড়া করতেই নাকে মিষ্টি মতো ঘ্রাণ পেয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই এই কাগজের শিটগুলোর সঙ্গে সেন্ট বা এসেন্স জাতীয় কিছু মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। দুএকটা বেয়াড়া রকমের বানান ভুলও লক্ষ্য করলাম। হাতের লেখা দেখে মনে হলো, যে ভদ্রলোক লিখেছেন তার মনটা বিক্ষিপ্ত । পড়ে ফেললে তো ভালমন্দ যাই থাকুক জেনে যাব! আর জেনে গেলে তো সমস্ত কৌতূহলের অবসান হয়ে গেল ।
আমি কাগজের শিটগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিলাম। তারপর সিগারেট ধরালাম। আগে শামারোখ চা নিয়ে আসুক। চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখা যাবে শিটগুলোতে কি আছে । দিলদার সাহেবের চিঠিটা আমার পকেটের ভেতর থেকে কৈ মাছের মতো উজান ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল । অন্য কোনো কিছু পড়ে দেখবার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই । শামারোখ চা এবং বিস্কুট টেবিলের ওপর রেখে বলল, পড়ে দেখেছেন? আমি বললাম, না। উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, ওগুলো কি? শামারোখ বলল, প্রেমপত্র। কাগজ থেকে গন্ধ পান নি? আমি বললাম, হ্যাঁ পেয়েছি। কিন্তু আপনি বলবেন তো প্রেমপত্রগুলো কে কাকে লিখেছে? শামারোখ বলল, আর কাকে লিখবে? লিখেছে আমাকে। আমি বললাম, সে তো নতুন কথা নয়। আপনাকে তো সব্বাই প্রেমপত্র লেখে। শামারোখ বলল, কই, আপনিতো লেখেন নি? আমি বললাম, সময় পেলাম কই? ঝুট-ঝামেলা নিয়েই তো ব্যস্ত থাকতে হলো। চা খেতে খেতে বললাম, ওই গন্ধঅলা চিঠিগুলো কি একান্তই আমাকে পড়ে দেখতে হবে?
পড়বার জন্যই তো দিলাম ।
আপনাদের হার্ভার্ড ফেরত প্রফেসর আবু তায়েবের কাণ্ড দেখুন ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তায়েব সাহেবের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
পরিচয় না থেকে উপায় কি বলুন! ভদ্রলোক প্রতি হপ্তায় আসেন। একবার বসলে আর উঠতেই চান না। আমাকে জ্বালিয়ে মারলেন। প্রতি হপ্তায় চিঠি আসছে তো আসছেই।
ঠিক তক্ষুনি আবার মনে পড়ে গেল, একবার প্রফেসর তায়েব আমাকে জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বনানীর আকাশছোঁয়া রেস্টুরেন্টটায় নিয়ে গিয়েছিলেন। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমার কাছ থেকে শামারোখ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন। তায়েব সাহেব প্রায়ই শামারোখের কাছে আসেন এবং প্রতি হপ্তায় তাকে সেন্ট মাখানো কাগজে প্রেমপত্র লেখেন, এ সংবাদ শুনে তার ওপর আমার মনে একটা প্রবল ঘৃণার ভাব জন্মাল।
শামারোখকে আর কিছুই বলতে হলো না। একটা একটা করে চিঠিগুলো পড়ে গেলাম। চিঠি পড়ার পর আমার মনে একটা বিশ্রী প্রতিক্রিয়া জন্ম নিল । কাঁচের শোকেসের ভেতর সবকিছু যেমন খালি চোখে দেখা যায়, আমিও তেমনি তায়েব সাহেবের মনের চেহারাটা দেখতে পেলাম। আমার চোখের সামনে একজন হতাশ, অসহায়, একই সঙ্গে কামুক এবং অহংকারী মানুষের ছবি ফুটে উঠল। এই নিঃসঙ্গ বয়সী মানুষটার ওপর আমার মনে সহানুভূতির ভাব জন্মাতে পারত। কিন্তু সেটা হলো না। শামারোখের কাছে উলঙ্গভাবে প্রেম নিবেদন করেছে, সেটাই আমার প্রধান নালিশ নয়। বরং আমার রাগ হলো এ কারণে যে, ভদ্রলোক অতি সাধারণ বাংলা বানানও ভুল করেন। আর তিনি মনের অনুভূতি রুচিস্নিগ্ধ ভাষায় গুছিয়েও প্রকাশ করতে পারেন না। প্রতি ছত্রেই অহমিকা এবং দাম্ভিকতা হুংকার দিয়ে ওঠে। ভদ্রলোকের প্রায় প্রত্যেকটা চিঠির মর্মবস্তু বলতে গেলে ওই একই রকম। আমি একজন বিরাট মানুষ, সম্প্রতি বড়ই নিঃসঙ্গ এবং কামাতুর, সুতরাং তুমি আমার কাছে এসো। যা চাও সব দেব। প্রফেসর আবু তায়েবের বাড়িতে মেয়েরাও থাকতে চায় না কেন, এখন কারণটা অনুধাবন করতে পারলাম। তিনি মহিলাদের একটা পণ্য হিসেবেই দেখেন।
আমি এবার চিঠিগুলো শামারোখের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। শামারোখ বলল, ওগুলো নিয়ে আমি কি করব? আমি বললাম, আপনি কি করবেন, আমি কি করে বলব। ইচ্ছে হলে জবাব দেবেন, ইচ্ছে হলে চন্দন কাঠের বাক্সে রেখে দেবেন। শামারোখ বলল, কি করি দেখুন । এই বলে সে ভেতরে চলে গেল। একটা হিটার নিয়ে এসে প্লাগটা সুইচ বোর্ডে লাগিয়ে নিল। কয়েলটা যখন লাল হয়ে উঠেছে, শামারোখ তখন একটা একটা করে চিঠিগুলো সেই জ্বলন্ত হিটারে ছুঁড়ে দিল। আমি দেখলাম, আবু তায়েবের হৃদয়-বেদনা, আসঙ্গলিপ্সা, নিঃসঙ্গতার আর্তি সবকিছু সর্বশুচি আগুনের শিখায় ভস্মে পরিণত হচ্ছে। শামারোখ এরকম একটা কাণ্ড করতে পারে, ভাবতে পারি নি। আমি ভীষণ খারাপ বোধ করতে থাকলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি দিলদার সাহেবের চিঠিটা পকেট থেকে বের করতে পারলাম না। বাতাসে পুড়ে যাওয়া চিঠির ছাই ইতস্তত ওড়াওড়ি করছে। মনে হলো, আবু তায়েবের মনের অতৃপ্ত কামনা-বাসনা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু ছাই এসে আমার বাম চোখে পড়ল এবং চোখটা জ্বালা করতে থাকল। বেসিনে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসে আমি চিঠিটা শামারোখের হাতে দিলাম। শামারোখ চিঠিটা পড়ে মন্তব্য করল, মনে হচ্ছে, জায়গাটা উত্তর মেরুরও উত্তরে। অত দূরে যাব কেমন করে? আর ভদ্রলোকও-বা অত দূরে থাকেন কেন?
আমি বললাম, দিলদার সাহেব আগে ধানমন্ডি পনের নম্বরে থাকতেন। সম্প্রতি তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বাড়িটা দিলদার সাহেবের প্রথম বেগমের নামে। শামারোখ জানতে চাইল, এই বয়সে স্বামীকে তাড়িয়ে দেবে কেন? আমি পাল্টা জবাব দিলাম, এই বয়সে আপনিও-বা স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসবেন কেন? আমার প্রশ্নটা শুনে শামারোখ সোজা হয়ে বসল। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। তারপর উঠে কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল। মনে হলো, আমি তার অসম্ভব নরম জায়গায় আঘাত করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পরে এসে শামারোখ জিজ্ঞেস করল, আপনার দিলদার সাহেব মানুষটা কি বদমাশ? এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আবার বিয়ে করলেন কেন? আমি বললাম, এক অর্থে আপনার কথা সত্যি। কিন্তু মানুষটা আরো অনেক কিছু। তিনি ভাল কবিতা লেখেন, চমৎকার বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। অসাধারণ সাহসী মানুষ। শামারোখ আমার মুখের কথা টেনে নিয়ে বলল, সাহস জন্তু-জানোয়ারেরও থাকে। আপনারা পুরুষ মানুষেরা আপনাদের অপরাধগুলোকে গুণ হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টার কসুর করেন না।