কে আব্ব, শামারোখের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
তার বাবা বললেন এক ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য বসে আছেন।
এত সকালে আবার কে এল? আর পারি নে বাবা! শামারোখের করুণ ক্লান্ত কণ্ঠ। কলের পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বুঝলাম, শামারোখ বাথরুমে ঢুকেছে।
আমাকে বেশিক্ষণ বসতে হলো না। শামারোখ দরজার ভেতর থেকেই আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, ও, আপনি? তার গলার স্বর আটকে গেল। সেই রাতে ফেরত পাঠাবার পরে শামারোখের সঙ্গে আমার আর দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি। আমাকে দেখে সে খুশি হয়েছে, চোখ-মুখের ভাব থেকেই সেটা ফুটে উঠেছে। আমি বললাম, শামারোখ আপনি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলোও সঙ্গে রাখবেন । এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে ।
শামারোখ বলল, আপনি সকালে নাশতা করেছেন? আমি বললাম, না। সে বলল, বসুন নাস্তা দিতে বলি। আমি বললাম, সময় হবে না, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। পথে কোথাও নাশতা খেয়ে নেয়া যাবে। শামারোখের একটি অভ্যাসের তারিফ অবশ্যই আমাকে করতে হবে। ভদ্রমহিলারা সাধারণত বাইরে বেরুবার আগে সাজতেগুজতে এত সময় ব্যয় করে ফেলেন যে অপেক্ষমাণ লোকটির চূড়ান্ত বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়েন। শামারোখ এদিক দিয়ে অনেক নির্ভার। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই পরনের শাড়িটা পাল্টে একটা ফাইল হাতে করে বেরিয়ে এল।
আমরা একটা রিকশা নিলাম এবং পুরনো পল্টনের মোড়ে এসে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে নাশতাটা সারলাম। খেতে বসেই আমি শামারোখকে দিলদার সাহেব সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করলাম। আমাকে খুব বেশি বলতে হলো না। শামারোখ নিজেও দিলদার হোসেন সাহেবকে চেনে। আমি আরো বললাম, আমি তাকে তার চাকরিটার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাতে দিলদার সাহেবকে একরকম রাজি করিয়েছি। বিস্ময়ে শামারোখের চোখজোড়া কপালে উঠে গেল, এখনো আপনি আমার চাকরির কথা মনে রেখেছেন? আমার ডান হাতে সে একটা চাপ দিল। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। শামারোখকে আজ অনেকটা সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
দিলদার হোসেন সাহেব অফিসে একা ছিলেন। আমরা যখন স্যুয়িং ডোর টেনে ভেতরে ঢুকলাম, তিনি কলকণ্ঠে অভ্যর্থনা জানালেন, এসো। আমি এখন বুড়ো হয়ে গেছি, মহিলারা আর আমার খোঁজ নিতে আসে না। শামারোখের একটা সুন্দর জবাব যেন তৈরি হয়েই ছিল। সে বলল, আপনি একটা খবর দিলেই তো পারতেন। আমি চলে আসতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের খতরনাক লোকগুলো তোমাকে আটকে দিয়েছে, না? কাগজপত্রগুলো বুঝিয়ে দাও। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা সম্ভব হয়েছে। দিলদার সাহেবের কথা শেষ হতেই আমার গা থেকে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। আমি আশঙ্কা করেছিলাম দিলদার সাহেব তার খিস্তির তোড়ে আমাদের নাজেহাল করে ছাড়বেন। আজকে তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যবহার করলেন।
আমরা কাগজপত্র বুঝিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আজকে আমার হাতে সময় নেই। আরেকদিন এসো, গল্প করা যাবে। দেখি তোমাদের জন্য কিছু করা সম্ভব হয় কিনা। তিনি বাইরে বের হবার জন্য পা বাড়ালেন । আমাদেরও উঠতে হলো।
সাত আট দিন পর দিলদার হোসেন সাহেবের অফিসের পিয়ন একটা চিরকুট নিয়ে এল। তিনি লিখেছেন, ‘জাহিদ, তুমি আগামীকাল সন্ধ্যে বেলা তোমার বান্ধবীকে নিয়ে ডেইজির বাড়িতে আসবে। তুমি বোধহয় জানো, আমি এখন ডেইজির ওখানে থাকি। ডেইজি বড় একা থাকে। তোমাদের দেখলে খুশি হবে । রাতের খাবারটাও ওখানে খাবে। তোমার বান্ধবীর জন্য একটা সুখবর আছে। সাক্ষাতে জানাবো । জায়গাটা একটুখানি দুর্গম । কিভাবে আসবে পথের ডিরেকশানটা দিচ্ছি। এগার নম্বর বাস স্টেশনের গোড়ায় এসে নামবে । তারপর হাতের ডানদিকে একটি চিকন গলি পাবে। সেই গলি দিয়ে হাজার গজের মতো এসে দেখবে গলিটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা আরেকটা গলিতে এসে মিশেছে। যে নতুন গলিটা পাবে তার ডান দিকটাতে ঢুকবে। পাঁচশ গজের মতো সামনে এগুলে একটা তালগাছ চোখে পড়বে। সেই তালগাছের পাশ দিয়ে দেখবে আরেকটা চিকন পথ আবার পুবদিক গেছে। কিছুদূর এলেই একটা ধানখেত এবং ধানখেতের পাশে পুকুর দেখতে পাবে। পুকুরের উত্তর পাড়ে টিনের বেড়া এবং টিনের ছাউনির একটা ঘর দেখতে পাবে। সেই ঘরটাতেই এখন আমরা থাকছি। রাস্তা চেনার জ্ঞান তোমার অল্প। সে জন্য পথের নিশানাটা চিঠির পেছনে এঁকে পাঠালাম। একটু বেলা থাকতেই এলে তোমাদের বাড়িটা খুঁজে নিতে সুবিধে হবে। যদি রাত করে আস, বিপদে পড়ে যেতে পার । এদিকটাতে প্রায়ই লোডশেডিং হয়। একবার কারেন্ট গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আর রাস্তা-ঘাটে ডাকাত হাইজ্যাকারদের বড় উৎপাত।
আমি চিঠিটা নিয়ে শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গেলাম। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কড়া নাড়তেই খুলে গেল। শামারোখকেই সামনে পেয়ে গেলাম। মনে হলো সারা বাড়িতে আর কেউ নেই। আগে যখনই গিয়েছি প্রতিবার তার বাবাকে খাটের ওপর ঝুঁকে পড়ে কোরান অনুবাদ করতে দেখেছি। আজ তাকে দেখলাম না। খাটময় আরবি-বাংলা কোরআন এবং কোরআনের তফসির ইতস্তত ছড়ানো। কি কারণে জানি নে আজ শামারোখের মুখখানা অসম্ভব রকমের থমথমে। তার এ-রকম মূর্তি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সে ঠাণ্ডা গলায় আমাকে বলল, বসুন। দড়িতে ঝোলানো গামছাটা নিয়ে কাঠের চেয়ার থেকে ধুলো মুছে দিল। আমি জুত করে বসার পর শামারোখ ভেতর থেকে এসে একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, আপনার জন্য চা করে আনি। ততক্ষণে বসে বসে এগুলো পড়ে দেখুন।