কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি ছন্দ-মাত্রা মিলিয়ে নিখুঁত কবিতা লিখে দিতে পারেন। অবসরে হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের চেয়ার-টেবিল বানাতে তার জুড়ি নেই। তার গাড়িটা বিকল হলে মিস্তিরি ডাকার বদলে নিজেই আধময়লা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে গাড়ির তলায় শুয়ে নাট-বল্ট খুলে খুলে মেরামত করে ফেলেন। এক সময় রেসের ঘোড়া পুষতেন। এক সময়ে গরুর ব্যবসাও করেছেন বলে শুনেছি। দিলদার সাহেব এত প্রবলভাবে বেঁচে আছেন যে কোনো ব্যাপরে তার বাছ-বিচার নেই বললেই চলে। এই বুড়ো বয়সেও এক তরুণীকে কেন্দ্র করে তার নামে কেলেংকারীর কাহিনী রটে যায়। এই নিয়ে তার অত্যন্ত আধুনিকা রুচিবান স্ত্রী রাগারাগি করলে সেই তরুণীকে বিয়ে করে ফেলেন। বাড়িটা ছিল স্ত্রীর নামে। মহিলা তাকে খোটা দিলে দিলদার সাহেব বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে অফিসে থাকতে আরম্ভ করেন। তখন তার হাতে বিশেষ টাকা-পয়সা ছিল না। বন্ধু-বান্ধব একে তাকে ধরে আরেকটা বাড়ির ব্যবস্থা করেন এবং তখন তিনি নতুন স্ত্রী নিয়ে সেই বাড়িতেই থাকছেন। তিনি এমন অনেক কাজ করেছেন, যেগুলো আমাদের চোখেও মনে হয়েছে রীতিমতো অন্যায়। যখন কৈফিয়ত চেয়ে জিজ্ঞেস করেছি, দিলদার ভাই ও কাজটা কেন করলেন, তিনি দরাজ গলায় জবাব দিয়েছেন, আমার খুশি আমি করেছি। তোমার খারাপ লাগলে আসবে না। আমি ঘ্যানঘ্যান করা অপছন্দ করি।
দিলদার সাহেবের হাঁপানির টানটা কমে এলে আমি তার কাছে শামারোখের চাকরি সংক্রান্ত কাহিনীটি বয়ান করি। তার বর্তমান অসহায়তার কথাটাও উল্লেখ করি। তিনি আমার কথা শুনে ক্ষেপে উঠলেন, শালা তুমি একটা আস্ত হিজড়ে, কিছু করার মুরোদ নেই, আবার ওদিকে প্রেম করার শখ। দিলদার সাহেব, ওরকমই । প্রথমে একচোট গালাগাল শুনতে হবে, সেটা জেনেই এসেছি। আমি চুপচাপ অগ্ন্যুৎপাতটা হজম করলাম। তিনি কাজের ছেলেটাকে ডেকে হুকুম করলেন, এই বাচ্চা, দু-কাপ চা লাগাও। তিনি নিজের কাপটা টেনে নিয়ে আমাকে বললেন, চা খাও। চায়ে চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বুঝলাম, প্রথম ধকলটা কেটে গেছে। এখন তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা যাবে। তিনি বললেন, শালা তোমার অবস্থা হয়েছে পীরের বাড়ির কলা চোরের মতো। চোর পীরের বাড়ির কলার ছড়াটা কেটেছিল ঠিকই। কিন্তু নিয়ে যাওয়ার বেলায় দেখল ব্যাটার এক পা-ও নড়ার সাধ্য নেই । পীর সাহেব দোয়া পরে কলার ছড়াটা আগে থেকেই রক্ষা করার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তা আমার কাছে কেন এসেছ, সেটা আগে বলে ফেল। তোমার সামান্য লাজ-লজ্জাও নেই। প্রেম করবে তুমি আর কষ্ট দেবে আমাকে। শালা, আমার যে তোমার বাপের মতো বয়স, সে কথাটি খেয়াল করেছ? দিলদার সাহেবের এসব কথা তো শুনতেই হবে।
আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রীকে যদি একবার অনুরোধ করা যায়, তাহলে হয়তো শামারোখ কাজটা পেতে পারে। আজ আমার কপালটাই খারাপ। দিলদার সাহেব ফের চটে গেলেন। তোমার কি আক্কেল, একটি মেয়ে মানুষের সঙ্গে তুমি প্রেম করবে, আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তার চাকরির ব্যবস্থা করবেন। এই জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছ তোমাদের মতো লোকদের জন্যই দেশটা গাড়ায় পড়ে আছে।
আমার মনটা দমে গেল। দিলদার সাহেব বোধহয় আমার অনুরোধটা রাখবেন না। আমি অনুভব করছিলাম, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। দিলদার সাহেব পাঞ্জাবির গভীর পকেট থেকে নস্যির কৌটোটা বের করে এক টিপ নস্যি নিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অমন করে আচাভুয়োর মতো বসে রইলেন কেন? এখন কাটো, আমার কাজ আছে।
আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। আমার কণ্ঠ দিয়ে সমস্ত আকুলতা মেশানো একটা স্বরই শুধু বেরিয়ে এল, দিলদার ভাই। আমার মনে হচ্ছিল আমি কেঁদে ফেলব। হঠাৎ দিলদার সাহেবের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পেলাম । তার চোখ জোড়া মমতায় মেদুর হয়ে এসেছে। তিনি বললেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা সেকি চাট্টিখানি কথা! তুমি তো শালা মিনমিন কর। হুলো বেড়ালের মতো ইশক মাথায় উঠে গেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলব কি? কাগজপত্র কোথায়, তোমার সুন্দরীকে নিয়ে আসবে আগামী শনিবার। মনে মনে তৈরি থাকবে যদি আমার মনে ধরে যায় আর ফেরত পাবে না।
শনিবার সকালে আমি শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গেলাম। তখন বেলা বড়জোর আটটা। শামারোখের বাবা খাটের ওপর ঝুঁকে পড়ে কি সব লেখালেখি করছেন। খাটে ছড়ানো আরবি বই । হয়তো তিনি কোরআনের সেই তরজমার কাজটাই করছেন। ভদ্রলোকের গায়ে একটা অতি সাধারণ গামছা। তাতে পিঠের একাংশ মাত্র ঢাকা পড়েছে। আমি দেখতে পেলাম তার সারা শরীরে লম্বা সাদা লোমে ভর্তি। আমি সালাম দিলাম । উত্তর দেয়ার বদলে ভদ্রলোক বললেন, টুলু তো ঘুমিয়ে আছে। আমি বললাম, একটু ডেকে দেয়া যায় না? ভদ্রলোক বললেন, আমি তো মেয়েদের ঘরে যাই নে। আমি একটু চাপ দিয়েই বললাম, ডেকে দিতে হবে, একটা দরকার আছে। ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন, কিন্তু খাট থেকে নেমে মোটর টায়ারের স্যান্ডেলে পা গলিয়ে একটুখানি ভেতরে গিয়ে ডাকতে লাগলেন, ও টুলু, টুলু, ওঠো। তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এক ভদ্রলোক এসেছেন।