আমি যদি শামারোখের কথা মাফিক তাকে বিয়ে করে ফেলতাম সেটা খুব ভাল কাজ হতো। হয়তো এ বিয়ে টিকত না। অনেক বিয়েই তো টেকে না। কিন্তু আমি মনের ভেতরে কোনো সাহস সঞ্চয় করতে পারছি নে। শামারোখকে বিয়ে করলে আমাকে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে একটা বাসা করতে হবে। আমার চাকরিবাকরিও কিছু নেই। বাসা ভাড়া দেব কেমন করে? আর শামারোখকে চালাবোও-বা কেমন করে? শামায়রাখের যদি একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় থাকত, তা হলেও না হয় চিন্তা করা যেত। ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা হওয়ার কথা দূরে থাক, ওর নিজেরও ঠাই নেই। তাকে বড় ভাইয়ের বউয়ের হাতে রীতিমতো অপমান সহ্য করে সে বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। শামারোখ একটা ভাসমান অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাকে আমি এই কমাসে যতদূর বুঝতে পেরেছি, এই মানসিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের পেছনে সত্যিকার ভালোবাসা সত্ত্বেও আমি তাকে একবিন্দু নিশ্চয়তাও দিতে পারব না। শামারোখকে নিয়ে আমি কি করব?
আমি যদি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করি, শামায়োখ যেসব মানুষের হাতে গিয়ে পড়বে, যাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, হয়তো তাদের একজনকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে। আমি জানি শামারোখের মাথায় অনেক রকমের কিড়ে আছে, কিন্তু তার যে লোভ নেই, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই যদি থাকত এই সমস্ত টাকাঅলা প্রতিষ্ঠাবান মানুষদের কোনো একজনকে সরাসরি সে বিয়ে করে ফেলত। শামারোখ তার শারীরিক সৌন্দর্য সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন, একথা সত্য। কিন্তু মানসিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটি তার কাছে তারও চাইতে বড় । কিন্তু পরিস্থিতি যখন চাপ দিতে থাকে, অনেক সময় বনের বাঘও ঘাস চিবিয়ে খেতে বাধ্য হয়। অস্তিত্বের যে সংকট কোনো মানুষই সেটা অতিক্রম করতে পারে না। শামারোখের পছন্দ করার গণ্ডি অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। ওই অবস্থায় সে ওই তাড়িয়ে-বেড়ানো লোকদের ভেতর থেকে যদি একজনকে বিয়ে করে বসে, হয়তো জীবনে অসুখী হবে। কিন্তু আমি সবার উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে। সবাই বলবে, আমি এতদিন শামায়োখের ভেড়য়াগিরি করে কাটিয়েছি। এতদিন সে আমাকে দেহরক্ষী হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং যখনই সুযোগ পেয়েছে আমাকে ল্যাং মেরে এক ধনী লোকের ঘরণী হয়ে বসেছে। কারো কাছে আমার মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। সবাই আমাকে করুণা করবে। যতই ভেতরের কথা আমি বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করি কেন, কে আমার কথা বিশ্বাস করবে?
আমি তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম ওই অবস্থা থেকে শামায়োখকে এবং আমাকে উদ্ধার করার জন্য এমন একটা কিছু করা প্রয়োজন, যাতে করে অল্প পরিমাণে হলেও শামারোখ তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে । ভেবে ভেবে ঠিক করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটি যদি সে কোনোভাবে পেয়ে যায়, আপাতত সবদিক রক্ষা পেতে পারে। আমি মনে মনে সান্ত্বনা পাব এই ভেবে যে, শামারোখকে একটা অবস্থানে অন্তত দাঁড় করিয়ে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে পেরেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা তাকে ঢুকতে না দেয়ার জন্য যে ধনুক ভাঙা পণ করে বসে আছেন, সেটাও ভেঙে ফেলা যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুই ঘটছে না। যদি কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রী অবধি যাওয়া যেত একটা রাস্তা হয়তো পাওয়া যেত। আমি একথা আগেও চিন্তা করেছি।
চিন্তাটা মাথায় রেখেই মতিঝিলে দিলদার হোসেন সাহেবের অফিসে গেলাম। আমি তাকে অফিসের সামনেই পেলাম। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে দরাজ গলায় হুংকার ছাড়লেন, এই যে ছোঁড়া এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে, আস নি কেন? আমি আমতা আমতা করে বললাম, দিলদার ভাই, হঠাৎ করে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, সে জন্য আসতে পারি নি। দিলদার সাহেব জোরালো গলায় বললেন, জানি, জানি, সব খবর জানি। আমার কাছে কোনো সংবাদ গোপন থাকে? এমন এক সুন্দরীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, যাকে দেখলে ঘোড়াগুলো পর্যন্ত নাকি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সব জায়গায় যাচ্ছ, আমার কাছে আস নি কেন? আমি কি তোমার সঙ্গে ভাগ বসাতে চাইতাম? ছোঁকড়া এখন তোমরা ওড়ার চেষ্টা করছ। এক সময় আমাদেরও দিন ছিল, আমরাও চুটিয়ে প্রেম করেছি হে। তুমি একা কেন? তোমার সুন্দরী কোথায়? সেই সময়ে তার হাঁপানির টানটা প্রবল হয়ে উঠল। তিনি চেয়ারে বসে পকেট থেকেই ইনহেলার বের করে টানলেন। তারপর দুতিন মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
দিলদার হোসেন সাহেব একজন সত্যিকার ডাকাবুকো স্বভাবের মানুষ। তিনি ভাল কি মন্দ এসব কথা চিন্তা করার সময় আমার হয়নি। ওই মানুষটির পৌরুষ এবং সাহস আমাকে সব সময় আকর্ষণ করেছে। হাঁপানি তাকে কাবু করে ফেলেছে। তারপরও এই প্রায় ছয় ফিট লম্বা মানুষটা যখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান, তাকেও আমার চিরন্তন যৌবনের প্রতীক বলেই মনে হয়। তার কাছে অসম্ভব বলতে কিছু নেই, সব সময় যেন ঝুঁকি গ্রহণ করতেই তিনি তৈরি হয়ে রয়েছেন।
কঠিন সমস্যায় পড়লেই মানুষ তার কাছে আসে। তিনি সবকিছু মোকাবেলা করেই যেন আনন্দ পেয়ে থাকেন। কেউ টাকা-পয়সা চাইলে উদার হাতে বিলিয়ে দেন। আবার কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিজে গ্রহণ করলে শোধ দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে যেতেও কসুর করেন না। ক্লাবে বসে গ্লাসের পর গ্লাস তাজা হুইস্কি যেমন পান করেন, তেমনি তাকে তার অত্যন্ত গরিব পিয়নের সঙ্গে কচুর লতি দিয়ে পান্তা ভাত খেতেও দেখেছি। এই মানুষটাকে আমি কোনো সীমা, কোনো সংজ্ঞার মধ্যে বাঁধতে পারি নি, যেন অনায়াসে সব কাজ করার জন্যই তার জন্ম হয়েছে।