শামায়োখের বাড়িতে আমি গিয়েছি এবং দেখেছি, আপন বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে কীভাবে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে থানায় গিয়ে নালিশ করার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। আমার মনে হলো শামারোখের সঙ্গে একই ছাদের তলায় একমাসও যদি আমাকে থাকতে হয়, তাহলে সে আমাকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলবে অথবা আমি তাকে খুন করে ফেলব। সমস্ত বিষয় চিন্তা করে আমার মনে হলো, আমি যেমন মাতৃগর্ভে আবার ফেরত যেতে পারি নে, তেমনি শামারোখকে বিয়ে করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। অসম্ভব এই কথাটি মনে হওয়ায় আমার দু’চোখের কোণায় পানি দেখা দিল। আমি নিজেকে ধিক্কার দিলাম। পুরুষ মানুষ হয়ে আমার জন্ম হয়েছিল কেন? একটি অসহায় নারী শেষ ভরসাস্থল মনে করে আমার কাছে ছুটে এসেছিল, আমি চূড়ান্ত অপমান করে তাকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি। আমি কি এতই পাষণ্ড যে ঈশ্বরের দান করা এই সৌন্দর্য এবং মেধাকে আমি অপমান করতে পারি! আমি কাপুরুষ নই, পাষণ্ডও নই, একথা আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো। শামারোখ আমাকে বলুক তার পেছন পেছন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছুটে যেতে, কোনোরকম দ্বিধা-সংশয়ের বালাই না রেখে এক কাপড়ে আমি তার পেছন পেছন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছুটে যেতে পারি। শামারোখ আমাকে নির্দেশ করুক অন্য কোনো নারীর মুখের দিকে না তাকাতে, সমস্ত জীবন আমি শামারোষের মুখমণ্ডলের কথা চিন্তা করে কাটিয়ে দিতে পারব।
পারব শামারোখকে খুন করে কবর দিয়ে সেই কবরের পাশে মোমবাতি এবং ধূপধুনো জ্বালিয়ে সেবায়েত হিসেবে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে। ওপরে যা বললাম, শামায়োখের জন্য তার সবটা আমি করতে পারব। কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারব না। আমার চাকরিবাকরি নেই। আগামী মাসে কোথায় যাব, কি করব জানিনে। আমার বাড়িঘরের দুর্দশার অন্ত নেই। যেদিকেই তাকাই দাঁড়াবার সামান্য জায়গাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। সুতরাং শামারোখকে নিয়ে এমন একটা জুয়াখেলায় মেতে উঠব কেমন করে! মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন রাজা হওয়ার প্রস্তাবও অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করতে হয়। একদিকে অসহায়তা, অন্যদিকে কাপুরুষতা আমাকে চিরে যেন দুটুকরো করে ফেলছিল। এই ঠাণ্ডাতেও আমার শরীরে ঘাম দেখা দিল। আমি চাপাগাছটার গোড়ায় হেলান দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, এ অবস্থায় আমি কিভাবে শামারোখের কাজে আসতে পারি? অঙ্গভরা সৌন্দর্য এবং তুলনা-রহিত হৃদয়বৃত্তির অধিকারী এই অসাধারণ নারী সব কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য আমি ঝুঁকি নিয়ে হলেও কিছু যদি না করতে পারি, আমার মানবজনম বৃথা। শামারোখ যাতে সম্মান নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে ব্যাপারে কিছু করার চেষ্টা তো আমি করতে পারি । আবার মনে পড়ল, শামায়োখ প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির ব্যাপারে খবর নেয়ার জন্যই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমি তার চাকরিটার চেষ্টাই করি না কেন? কিন্তু আমি কতটুকু সাহায্য করতে পারি? বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরিটাই হয় নি, সেই আমি শামারোখকে চাকরি দেব কেমন করে? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কর্তাব্যক্তি তাদের একটা ত্রুটি ঢাকা দেয়ার জন্য, শামারোখ যাতে কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে না পারে, তার জন্য সবাই এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমি ধৈর্য ধরে টানাটানি করলে হয়তো মোষের শিং থেকে দুধ বের করে আনতে পারব, কিন্তু এই নিষ্ঠুর মানুষগুলোর প্রাণে দয়া এবং অনুকম্পা সৃষ্টি করব কেমন করে? তক্ষুনি আমার, কেন বলতে পারব না, প্রধানমন্ত্রীর কথাটা মনে হলো। আজকাল তার ইচ্ছেতেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে সব কিছু ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী যার কথা শুনবেন, এমন একজন মানুষ আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার মনে হঠাৎ করেই সৈয়দ দিলদার হোসেনের মুখখানা ভেসে উঠল।
গত এক সপ্তাহ ধরে আমার মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমার এই মানসিক অবস্থা বন্ধু-বান্ধব কারো কাছে তুলে ধরতে পারছি নে। আমার অকৃত্রিম বন্ধুদের প্রায় সবাই পরামর্শ দিয়েছিলেন শামারোধের সঙ্গে আমি যেন মেলামেশা না করি । কারণ তারা মনে করেন, শামারোখ আমাকে বিপদে ফেলে দেবে। এই বন্ধুদের কাছে আমার মুখ খুলবার উপায় নেই। আর যারা আমার নামকাওয়াস্তে বন্ধু, তাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে পরামর্শ করার প্রশ্নই ওঠে না। এরা মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি, আমাকে তারা মনে মনে ভীষণ ঈর্ষা করে। আমি সবদিক দিয়ে একজন দাগ-ধরা মানুষ। দেখতে আমি সুদর্শন নই, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার উজ্জ্বল কৃতিত্বের দাবিদার নই। আমার টাকা-পয়সা নেই এবং পেশায় আমি একজন বেকার। এইরকম একজন মানুষের সঙ্গে শামারোখের মতো একজন রূপসী মহিলা সকাল-দুপুর ঘোরাঘুরি করবে, তারা সেটা সহ্য করবেন কেন? পথে ঘাটে দেখা হলে তাদের কেউ কেউ চিকন করে হাসে। তাদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে বসে, কি ভায়া, প্রেম-তরণী কোন ঘাটে নোঙর করল? হালটা শক্ত হাতে ধরবে। যদি একেবারে ভেসে যাও, সেটা ভাল কাজ হবে না।
শামারোধের সঙ্গে মেলামেশার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে আমি আমার শিক্ষকদের সঙ্গেও দেখাশোনা করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ তাদের অনেকেই এর মধ্যে সিদ্ধান্ত করে বসে আছেন আমি শিক্ষক সমাজকে অপমান করার জন্যই শামারোখকে নিয়ে এমন বেপরোয়াভাবে সব জায়গায় ঘোরাঘুরি করছি। নিজের ভেতরে সন্দেহ, সংশয় এবং অনিশ্চয়তার যখন পাহাড় জমে ওঠে এবং সেটা যখন কারো কাছে প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, যন্ত্রণা তখন হাজার গুণে বেড়ে যায় ।